বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আলোচিত বিষয় লন্ডন বৈঠক। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক ঘিরে দলগুলোর মধ্যে স্বস্তি-অস্বস্তি বিরাজ করছে। শুরুতে বৈঠককে স্বাগত জানালেও বৈঠক পরবর্তী সরকার ও বিএনপি’র যৌথ বিবৃতি নিয়ে আপত্তি অন্য দলগুলোর। ঘটনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এ ঘটনাকে ইস্যু করে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকও বয়কট করেছিল জামায়াতে ইসলামী। অন্যদিকে ছাত্রদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিও এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। দলটি প্রকাশ্যে বৈঠকের বিরোধিতা করেছে। তাদের দাবি- এটি ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্ব প্রক্রিয়া। এ-ও বলা হয়েছে- বাংলাদেশের ফয়সালা হবে ঢাকায়, লন্ডন নয়। এ বৈঠক পরবর্তী এনসিপি’র রাজনীতিতে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএনপি’র সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়ছে। দলটির নেতাদের বক্তব্যে সরকারের সমালোচনাও দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় এনসিপি’র রাজনীতি কী হবে, সরকারের পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন হবে কিনা, এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কৌশলই বা কী হবে- সেই প্রশ্ন সামনে আসছে। গত ১৩ই জুন বৈঠকের পরপরই নাগরিক পার্টির নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ওই বৈঠককে ‘গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি’ বলে কঠোর সমালোচনা করেছে। তিনি বলেন, বিদেশের মাটিতে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের এই আলোচনা দেশবাসীর স্বার্থের সঙ্গে প্রতারণা এবং গণআকাঙ্ক্ষাকে অবমাননার শামিল। দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে দেশের মাটিতে, জনগণের দ্বারা; কোনো বিদেশি আলোচনার মাধ্যমে নয়। এনসিপি’র মুখ্য সমন্বয়কারী বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যদি সংস্কার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু করতে ব্যর্থ হয়, তবে এনসিপি দ্বিতীয় গণ-অভ্যুত্থানের ডাক দিতে বাধ্য হবে। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে আমরা কোনো নির্বাচনেও অংশ নেবো না। তার মতে শুধু রাজা বা রানী বদল নয়, প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন।
পরদিন দলটি ওই বৈঠক নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিও দিয়েছে। এতে বলা হয়, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি। বিষয়টিকে ‘অত্যন্ত হতাশাজনক’। এনসিপি’র যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহউদ্দিন সিফাত স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে এনসিপি। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে লন্ডনে অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকটি ‘সংসদ নির্বাচন’ বিষয়ে দলটিকে আস্থায় আনতে সফল হয়েছে সরকার। জাতীয় ঐক্য, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। কিন্তু বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নাগরিকদের প্রধান দাবি তথা বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক বলে মনে করে এনসিপি। নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে বারবার প্রতীয়মান হচ্ছে উল্লেখ করে এনসিপি আরও বলেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, জুলাই সনদ কার্যকর করা এবং বিচারের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন গণ-অভ্যুত্থানকে স্রেফ একটি ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে পরিণত করবে এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন-আকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করবে। জনগণের দাবি তথা জুলাই সনদ রচনা ও কার্যকর করার আগে নির্বাচনের কোনো তারিখ ঘোষিত হলে তা জনগণ মেনে নেবে না বলেও উল্লেখ করে এনসিপি। বিবৃতিতে বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংস্কারের বিষয়গুলোর ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ও জুলাই সনদ রচনা এবং কার্যকর করেই আসন্ন জুলাইকে যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করার উদ্যোগ নিতে সরকারকে জোর দাবি জানাচ্ছে এনসিপি। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত বলেও বিবৃতিতে জোর দেয়া হয়।
দলটির এমন কড়া প্রতিক্রিয়ার পর স্বভাবতই সামনে আসছে তাহলে কী সরকারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে এনসিপি। নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎই-বা কী। সমালোচকরা এতদিন বলতো দলগঠন থেকে বাকি সব প্রক্রিয়ায় এনসিপি সরকারের সহায়তা পেয়েছে। যদিও সরকার এবং এনসিপি এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের বৈঠকে সব সময় বিএনপি-জামায়াতের মতো গুরুত্ব পেয়েছে এনসিপি। বিষয়টি নিয়ে অন্য ছোট দলগুলোর মধ্যে অস্বস্তিও ছিল। প্রকাশ্যে অনেকে এর সমালোচনাও করেছে। তবে লন্ডন বৈঠক পরবর্তী এনসিপি’র সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়া কিছুটা গ্যাপ দেখা যাচ্ছে।
এনসিপি’র সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব কয়েকদিন আগে ‘জনতার চোখ’কে বলেছেন, বিগত ১ থেকে দেড় মাস বিএনপি’র বক্তব্য দেখলে বুঝা যায় তারা বিচার ও সংস্কার থেকে নির্বাচনে বেশি ফোকাস দিচ্ছে। সরকারের সঙ্গে আলোচনায়ও তারা বিচার ও সংস্কার নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। শুধু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে। তারা জাতীয়ভাবেও নির্বাচনের জোয়ার তুলে বিচার-সংস্কারকে অগুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চাইছে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকে নির্বাচন বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বৈঠকের পর ফুরফুরে দলটি। যৌথ বিবৃতিতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ইঙ্গিত মিলেছে। তবে এ নিয়েও আপত্তি আছে এনসিপি’র। দলটি মনে করে বিচার আর সংস্কারের পরই কেবল নির্বাচন হতে পারে। আর সরকার যদি বিচার ও সংস্কার থেকে নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দেয় তাহলে ভুল করবে। আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন বিচার-সংস্কারে অগ্রগতি হলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু তারা মিডিয়ায় প্রচার করছেন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। এসব থেকে বোঝা যায় তারা বিচার-সংস্কারে আগ্রহী না। জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণা নিয়েও তাদের আগ্রহ নেই ওভাবে। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই আগামী জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদ হয়ে গেলে সরকারকে বিচারকাজ এগিয়ে নিতে হবে। একই সঙ্গে দলগুলোর উদ্বেগকে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করবে। এরপর নির্বাচন ঘোষণা করলে এটি অর্থবহ হবে। অন্যথায় এটি ক্ষমতা হস্তান্তর হতে পারে। এদিকে সরকারের সঙ্গে বিচার ও সংস্কার ইস্যুতে দূরত্ব হলেও নির্বাচন নিয়েও ভাবছে দলটি। আদীব বলেন, এনসিপি চায় বিচার ও সংস্কারের দৃশ্যমান অগ্রগতি, এরপর নির্বাচন। নির্বাচন হলে এনসিপি অংশ নেবে। তবে তার থেকে আমাদের বেশি ফোকাস বিচার ও সংস্কারে।
ওদিকে নির্বাচনের আগে পুরোপুরি দল গোছানোয় মনোযোগী হয়েছে এনসিপি। ইতিমধ্যে চারটি মহানগর সমন্বয় কমিটি, ৩৫টি জেলা কমিটি, ১৪৮টি উপজেলা কমিটি, ১৩টি সেল এবং ১০টি উইং কমিটি দিয়েছে দলটি। এ ছাড়া গঠনতন্ত্র নিয়েও কাজ প্রায় শেষের দিকে। সবকিছু শেষ করে দলটি নিবন্ধনের জন্য আবেদন করবে। চলতি সপ্তাহে এটি হতে পারে বলে জানা গেছে। তার প্রাথমিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নিজেদের গঠনতন্ত্র, প্রতীক ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের কাজ চলছে।
দলীয় প্রতীক হিসেবে এনসিপি’র পছন্দের মধ্যে রয়েছে- মুষ্টিবদ্ধ হাত, দোয়াত-কলম, শাপলাসহ কয়েকটি প্রতীক। এনসিপি’র এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেতে প্রাথমিক কাজ আমাদের অনেকটা সম্পন্ন হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে আবেদন করে আমরা নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে মানুষের সামনে হাজির হতে চাই।
এদিকে যে কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে যাচ্ছে এনসিপি সে কমিশনের প্রতিই আস্থাশীল নয় দলটি। বেশ কিছুদিন ধরে এনসিপি নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। দলটি মনে করে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়। এ নিয়ে নির্বাচন ভবনের সামনে বিক্ষোভও করেছে তারা। এনসিপি কমিশন গঠনের আইন নিয়েই খোদ প্রশ্ন তুলেছে। দলটি বলছে- এ কমিশন ২০২২-এ পতিত শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে করা আইনের অধীনে গঠন করা হয়েছে। অথচ ইসি গঠনের কথা ছিল সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী। একই সঙ্গে বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে ‘পক্ষপাতমূলক আচরণ’-এর অভিযোগ করছে। বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের শপথ নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার জন্য নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করছে এনসিপি। বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেও এ কমিশনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে জানিয়েছে এনসিপি।
এনসিপি’র বর্তমান রাজনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক। সংবিধানের মৌলিক সংস্কারে চলা এসব বৈঠকে দলটি সংস্কার কমিশনের বেশির ভাগ সুপারিশকে সমর্থন করলেও মোটা দাগে বিএনপি’র সঙ্গে অধিকাংশ বিষয়ে মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন নিয়ে বিএনপি ও অন্যান্য দল দুই মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। বিএনপি মনে করে এ কাউন্সিলের জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নেই। তাই তারা এটিকে সমর্থন করতে পারে না। অন্যদিকে জামায়াত-এনসিপি সহ অধিকাংশ দল স্বচ্ছতার জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের পক্ষে। কারণ এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন সহ গুরুত্বপূর্ণ সব কমিশন গঠন হবে। বিএনপি এ কাউন্সিলের প্রতি সমর্থন না জানানোয় এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করে বলেছেন- কোনো কোনো দল ফ্যাসিবাদী কাঠামোকে সমর্থন করছে।
সব মিলিয়ে, আগামীদিনে এনসিপি কোন রাজনৈতিক অবস্থানে নিজেদের স্থাপন করবে, তা সময়ই বলে দেবে। জুলাই গণহত্যার বিচার ও কাঠামোগত সংস্কারে তারা অনড় অবস্থানে থাকবে, নাকি নির্বাচনী সমীকরণে অংশ নিতে নীতি শিথিল করবে-এটাই দেখার বিষয়। তবে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা ও সাংগঠনিক দুর্বলতা তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, তৃণমূলে প্রত্যাশিত জনসমর্থন এখনো গড়ে উঠেনি। মাঠের লড়াই আর ভোটের লড়াইয়ের পার্থক্য কতোটা তা বুঝে তবেই আগামী পথে এগোতে হবে দলটিকে। তবুও, এনসিপি আশাবাদী। দলটির নেতারা বলছেন, ‘জুলাই স্পিরিট’ ধারণ করে তারা ভবিষ্যতের রাজনীতিতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।