২০২৪-এর নির্বাচন শেষ। কয়েক সপ্তাহ পরে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়া এক প্রার্থীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলছিলেন, নির্বাচনে প্রায় অর্ধকোটি টাকা খরচ করেছেন। নির্বাচনে হারবেন জেনেও কেন নির্বাচনে নাম লেখালেন? তিনি তার ব্যবসার কিছুটা বর্ণনা দিলেন। বোঝা গেল অর্থনৈতিকভাবে শক্ত। এরপর বললেন, এই টাকাটা খরচ করে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালাম। বাংলাদেশের ইতিহাস যতদিন থাকবে ততদিন আমার নাম থাকবে। আমার নামে ব্যালট হয়েছিল এটার বর্ণনা থাকবে।
নির্বাচন, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এই নির্বাচনটা ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল গত এক যুগে। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসের সুখপাঠ লিখতে চাইলে এই সময়টা বাদ দিতে হবে। কিন্তু ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। ’২৪-এর পর ইতিহাসের নতুন অধ্যায় লেখা শুরু। বিশেষজ্ঞদের মতে দেশ এখন নির্বাচনের ট্রেনে। চলমান নানা জটিলতার সমাধান এসেছে লন্ডন বৈঠকে। মিলেছে নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট যৌথ বার্তা। অন্তর্বর্তী সরকারের চাওয়া এপ্রিলে নয়, বিএনপি’র চাওয়া ডিসেম্বরেও নয়। দুই পক্ষের সমঝোতায় ফেব্রুয়ারিতে হতে যাচ্ছে এই নির্বাচন। কিন্তু এই বৈঠকের পর অম্ল-মধুর সমস্যায় জাতীয় পার্টি। নির্বাচনের ঘণ্টা বেজে যাওয়ার পর তারা কী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবে নাকি নিষেধাজ্ঞার শঙ্কায় আড়ষ্ট থাকবে। আবার নতুন করে যোগ হয়েছে দলের শীর্ষ নেতাদের পিঠ বাঁচানোর লড়াই।
এ নিয়ে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। প্রত্যেকেই শোনালেন হতাশার কথা। তবে মনে হলো ইচ্ছাটা রয়েই গেছে ফের ব্যালটে নাম লেখানোর। কিন্তু শঙ্কা রয়েছে জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা তা নিয়ে। শঙ্কা রয়েছে নিষেধাজ্ঞার বাঁশির সুর শোনারও।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) একাধিকবার চেয়েছে জাতীয় পার্টির নিষেধাজ্ঞা। অনেক নেতাই আছেন বিরূপ পরিস্থিতিতে। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে চাপ। ঢাকার বাইরের জাতীয় পার্টির নেতাদের চাপ আরও বেশি। এনসিপি’র নবীন নেতাকর্মীদের সমীহ করতে হচ্ছে জাপা’র প্রবীণ নেতাদের।
জাতীয় পার্টি এখন রীতিমতো তৃণমূলবিহীন দল। তৃণমূলকে অবশ্য পাত্তাও দেন না শীর্ষ নেতারা। গত কয়েকটা নির্বাচনে তাদের সফলতা ছিল আঁতাত। যত বেশি মেলে হালুয়া-রুটির ভাগের প্রতিযোগিতা। আওয়ামী লীগের একপক্ষীয় ভোটের বৈধতা দেয়ার কাজটা নিরবচ্ছিন্নভাবে করে গেছে জাপা।
তবে দলটিতে এখন নেই নির্বাচনের আলাপ। তারা এখন দল-পদ বাঁচানো নিয়ে ব্যস্ত। কিছুটা দল গোছানোর কাজও চলছে। অজানা ধোঁয়াশা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার মাঝে দিন কাটছে তাদের। দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর উপর ভরসা রাখতে পারছেন না। এমনকি কাউন্সিলের মাধ্যমে দল পুনর্গঠন হবে বা পরিবর্তন আসবে এনিয়েও আশার বাণী উচ্চারণ করছেন না।
বরাবরই নির্বাচনমুখী জাতীয় পার্টি। নির্বাচন করতে চান অনেকেই লাঙ্গল প্রতীকে। অনেকেই নির্বাচনে নাম লিখিয়ে হতে চান ইতিহাসের অংশ। আওয়ামী লীগের ছায়াতলে থেকে নির্বাচন করেছে দলটি। যদিও ৫ই আগস্টের পর দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এই নির্বাচনে অংশ নেয়াটাকেই বড় করে তুলে ধরেন। জোর গলায় বলেন, নির্বাচনে অংশ নিয়ে কোনো অন্যায় করেননি। আবার পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ৫০ শতাংশ মানুষের মাঝে এই পরিস্থিতিতেও বলে যাচ্ছেন নিয়মিত।
জাতীয় পার্টির দ্বিধা-বিভক্তির আলোচনা নতুন কিছু নয়। চেয়ারম্যান জিএম কাদের তৃণমূলবিমুখ। এরশাদপত্নী রওশন এরশাদের সঙ্গে চেয়ারের লড়াইও হয়েছে কয়েকবার। রওশনপন্থিরা নাম লেখাননি ২০২৪’র নির্বাচনে। নির্বাচনের পর ক্ষোভ-ক্রোধ দেখা যায় প্রকাশ্যে। ৩০০’র অধিক নেতাকে করা হয় বহিষ্কার। দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, সরব অনেক নেতাই দাঁড়ান রওশন এরশাদের সারিতে। কাউন্সিলও করেন রওশন এরশাদপন্থিরা।
৫ই আগস্টের পর কম অপদস্থ হয়নি দলটি। দলটির কাউন্সিলের দাবি দীর্ঘদিনের। নেতাকর্মীদের অভিযোগ দলীয় পদ ধরে রেখেছেন জিএম কাদের। শুধুমাত্র ভাই হওয়ার কারণে সর্বোচ্চ আসনে আসীন। যদিও দেশের ইতিহাসে পরিবারতন্ত্র নতুন কিছু নয়। জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে হয়েছে মামলা। ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর আগে জিএম কাদের ও তার স্ত্রী শেরিফা কাদেরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
২৮শে জুন দলটির দশম কাউন্সিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্থান না পাওয়ায় তা আর হচ্ছে না। এবার ফের গুঞ্জন। ফের কী ভাঙতে যাচ্ছে দলটি? জিএম কাদেরকে সরাতে একাট্টা এক পক্ষ। পছন্দ হচ্ছে না মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর নেতৃত্বও। চাউর হয়েছে সিনিয়র নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার আসতে চান নেতৃত্বে। তারা সম্মেলনে দলীয় গঠনতন্ত্রের বহুল বিতর্কিত ধারা-২০, ১ এর (ক) উপধারাটিতে সংশোধনী আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই ধারার ক্ষমতাবলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান যেকোনো পদে যেকোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ, অপসারণ ও তার স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন। এই ধারাটিকে তারা চরম অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী বলছেন।
এক শীর্ষ নেতা বলেন, এই গঠনতন্ত্র সংশোধনের আভাস পেয়েই বাতিল করা হয়েছে ২৮শে জুনের সম্মেলন। তিনি বলেন, যখন কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হয় তখন বলা হয়েছিল চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র বরাদ্দ না পেলে ভিন্ন স্থান কিংবা কাকরাইলের দলীয় কার্যালয়ে হবে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই কাউন্সিল বাতিল করা হলো। ত্যক্ত-বিরক্ত অনেক নেতা যেমন এই কোরামে আছেন রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগ দেয়া শীর্ষ কিছু নেতাও আছেন। তিনি যোগ করেন রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগ দেয়া কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, কাজী মামুনুর রশীদ আছেন এই তালিকায়।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদের কাছে জানতে চাইলে তিনি চেয়ারম্যান ও এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব পদে লড়বেন বলে জানান। বলেন, আমরা কাউন্সিলের মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে চাই। মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও বলেছেন, ২০-এর (ক) উপধারাটিতে সংশোধন আনা জরুরি। এই কারণে যেকোনো নেতা; আমিও শঙ্কার মুখে থাকি।
জানা যায়, কাউন্সিলের মাধ্যমে চেয়ারম্যানের পদ ধরে রাখতে চান জিএম কাদের। কিন্তু চেয়ারম্যান পদে শীর্ষ নেতারা আসার কথা শুনে শঙ্কায় পড়েছেন তিনি। জিএম কাদের চান নিজে চেয়ারম্যান থেকে পছন্দের লোককে মহাসচিব করতে। তার পছন্দের তালিকায় রয়েছেন বর্তমান মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও শামীম হায়দার পাটোয়ারীর নাম। বহিষ্কার করা হতে পারে আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে; এই কথাও বললেন কয়েকজন।
তবে জিএম কাদের ও মহাসচিবের উপর ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে নেতাকর্মীদের। ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়া একজন প্রার্থী বলেন, এই দলটির আর কোনো সমাজে ইমপ্যাক্ট নাই। এদের নিয়ে কথা বলাও এখন সাজে না। ৫ই আগস্টের আগে জাতীয় পার্টির রাজনীতি করি এটা বললে মানুষ হাসতো। আর এখন ভয়ে থাকতে হয়।
জাতীয় পার্টির উইং ছাত্র সমাজের নেতা মৃধা মিরাজুল ইসলাম। তিনি বহিষ্কারের পর যোগ দেন রওশন এরশাদের প্যানেলে। তিনি বলেন, জিএম কাদের ২০, এর ১ (ক) ধারাটি ধরে রেখে যাকে তাকে বহিষ্কার করতে চান। এই ধারা এরশাদের জন্য প্রযোজ্য ছিল। কারণ তিনি দলটা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখন ক্ষমতা হারানোর ভয়ে কাউন্সিল বাতিল করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এই যে একের পর এক নেতাকে বহিষ্কার করা হলো। ক’জন যোগ্য লোককে দলে ভেড়াতে পেরেছেন?
লাঙ্গল প্রতীকে কিশোরগঞ্জ-৬ আসন থেকে নির্বাচন করেছিলেন নুরুল কাদের সোহেল। তিনি দলত্যাগ করে জনতা পার্টি বাংলাদেশে যোগ দিয়েছেন। তিনি এখন দলটির প্রধান সমন্বয়কারী। বলেন, জিএম কাদের খুব আতঙ্কে আছেন। জিএম কাদের নিজের ক্ষমতা বজায় রেখে কাউন্সিল করবেন। জাতীয় পার্টি নির্বাচন করতে পারবে বলে আমি মনে করি। জাতীয় পার্টি গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল না। দোসর ছিল। এর সকল দায়ভার যায় জিএম কাদেরের উপর। তার একার দায়, অন্য কারও নয়। ২০, ১-এর ক ধারায় সকল ক্ষমতার মালিক চেয়ারম্যান। তাহলে তারই দায়ভার।
তবে জিএম কাদেরের পক্ষেও কথা বলেন বরিশাল সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নির্বাচন করা ইকবাল হোসেন তাপস। তিনি বলেন, দলছুট হয়ে কেউ কখনো এগুতে পারে না। এর আগে তো রওশন এরশাদও কাউন্সিল করেছিল। এখন যারা দলকে ভাঙার চেষ্টা করছে তারাই ক’দিন আগে আওয়ামী লীগের ছায়ায় নির্বাচন করেছে। তাদের কারণেই জিএম কাদের আওয়ামী লীগের ছায়া থেকে বের হতে পারে নাই। তারা তৎপরতা শুরু করেছে নতুন করে হালুয়া-রুটির ভাগের আশায়।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পদে জিএম কাদেরের কোনো বিকল্প নাই। জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ আমি খুব একটা ভালো বা খারাপ বলবো না। এই দালালরা যদি দল থেকে বের হয়ে যায় নতুনরা যদি সামনে আসে- তাহলে ভালো কিছুই হবে।
সামপ্রতিক বিতর্কের মুখে ফের আলোচনায় এসেছে দলটি। একাধিকবার চেষ্টা করেও জিএম কাদেরের মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। আবার দলের বার্তা প্রেরণকারী হোয়াটসঅ্যাপ থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয় জিএম কাদের কাউকে কোনো মতামত জানাবেন না।
তবে একটি গণমাধ্যমে তিনি সমপ্রতি বলেন, সুবিধাভোগী কিছু নেতার কারণেই জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের দোসর বা দালাল হিসেবে অপবাদ দেয়া হয়। এর মধ্যে কেউ কেউ আছেন, যাদের আমরা সম্মান দিয়ে পদে রেখেছিলাম। তারা সব সময় বিনা পরিশ্রমে সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে হয়তো কেউ এদের কিছু প্রলোভন দিয়েছে। কিন্তু তারা কোথাও দাঁড়াতে পারবে না। আবর্জনার ওই গ্রুপটা দল থেকে চলে গেলে দলটা বরং শক্তিশালী হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।