তী র্য ক ম ন্ত ব্য

নির্বাচনের পুলসিরাত জুলাই সনদ

মোজাম্মেল হোসেন | মতামত
জুন ২১, ২০২৫
নির্বাচনের পুলসিরাত জুলাই সনদ

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে লন্ডনে নজিরবিহীন বৈঠকটির পরে দেশের রাজনীতিতে খানিক উত্তেজনা হ্রাস ও স্বস্তির ভাব যে এসেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও তা কতোদিন স্থায়ী হবে তাতে সন্দেহ আছে। 


মূল যে বিষয়ে উত্তেজনা কিছুটা কমেছে তা জাতীয় নির্বাচন তথা ত্রয়োদশ সংসদের জন্য ভোটাভুটির সময় নির্ধারণ নিয়ে। বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপ অর্থাৎ প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দেয়া থেকে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত ধাপগুলোর তারিখ দিয়ে একটি পথরেখা ঘোষণার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। নির্বাচন সম্পর্কে সরকার সিদ্ধান্ত নিলেই নির্বাচন কমিশন এই পথরেখা ঘোষণা করবে। গত বছর জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরে গত দশ মাস ধরে ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে অস্পষ্টতা রেখে চলায় বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের  সঙ্গে সরকারের একটি টানাপড়েন ও অবিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। শেখ হাসিনাসহ নেতারা পলাতক ও দল আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় এবং অবশেষে সরকারের আদেশে দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়ে পড়ায় সেই শূন্যতায় বিএনপি এখন দেশে বৃহত্তম দল এবং নির্বাচন হলে তারাই ক্ষমতায় যাবে বলে সর্বমহলে ধারণা রয়েছে। ফলে নির্বাচনের সময় নিয়ে অনিশ্চয়তায় বিএনপি’র সঙ্গেই সরকারের দ্বন্দ্বটা মুখ্য হয়ে ওঠে। বিএনপি চলতি বছর ডিসেম্বরে নির্বাচন চাচ্ছিল। শক্তির দিক থেকে পরবর্তী অবস্থানে থাকা জামায়াতে ইসলামী আন্দোলনকারী ছাত্রদের নবগঠিত সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচন কিছু দিন পিছিয়ে করতেও সম্মত। যদিও বিএনপি প্রথম থেকেই শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সরকারি নেতাদের বিরুদ্ধে আনা ক্ষমতায় থাকাকালীন মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের বিচার ও ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের স্বার্থেই রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিয়ে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিল। তবে আইনশৃঙ্খলার অবনতিসহ প্রশাসনিক নানা ব্যর্থতার মধ্যেই এই সংস্কার নিয়ে সরকারের কাজে সন্দেহজনক ধীরগতি, সরকার সমর্থক কিছু মহল থেকে বিনা নির্বাচনে ইউনূসকে ৫-১০ বছর ক্ষমতায় রাখার জন্য প্রচার ইত্যাদির ফলে অবিশ্বাস বাড়তে থাকে। প্রধান উপদেষ্টা অনেকদিন ধরে বলে আসছিলেন, সংস্কার অল্প বা বেশি করা সাপেক্ষে এ বছর ডিসেম্বর থেকে ২০২৬-এর জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এতে একটা অস্পষ্টতা থাকে। মে মাসের শেষ চারদিন প্রফেসর ইউনূস জাপান সফরের সময় বিদেশি মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দিয়ে তিনি বলেন যে, একমাত্র বিএনপি এ বছর ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়, অন্য কোনো দল চায় না। এ কথার মধ্যে সত্যতা না থাকায় বিএনপি’র সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক তিক্ততার দিকে যেতে থাকে। এ সময় হঠাৎ করেই প্রফেসর ইউনূস গত ৬ই জুন ঈদুল আজহা উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ঘোষণা করেন যে, ২০২৬-এর এপ্রিলের প্রথমার্ধে যেকোনোদিন নির্বাচন হবে। এই ঘোষণাও কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি এজন্য যে, এপ্রিলের প্রথম পক্ষটি কয়েকটি চিপার মধ্যে। তা হলো রোজার মাসে নির্বাচনী প্রচার চালাতে হবে, কাছাকাছি সময়ে দেশব্যাপী একযোগে  মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং ঋতুর দিক থেকে সময়টা ঝড়-বৃষ্টি-বন্যার। বিএনপি জোরালো আপত্তিই জানায়। ইউনূস আবার এক দ্রুত মোড় নিয়ে এক সপ্তাহের মাথায় ১৩ই জুন লন্ডনে তারেকের সঙ্গে বৈঠকে আলাপ করে উভয়ের যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা দেন যে, পরবর্তী রোজার আগে অর্থাৎ ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ভোট হতে পারে।

 
এবার কিন্তু ভোট  ‘হতে পারে’ এবং তাও শর্তসাপেক্ষে। যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী রোজার আগে নির্বাচনের প্রস্তাবটি জনাব তারেকের। বিবৃতির ভাষা হলো- “সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।”
পরিষ্কার ভাষায় সুনির্দিষ্ট না করে একটি ভাসা ভাসা সদিচ্ছায় ঐকমত্য। তবু আমরা বিশ্বাস করবো যে, সরকার এ কাজগুলো সমাধা করে ঐ সময়ে নির্বাচন হতে দেবেন। 
সরকার এবং একটিমাত্র দলের নেতার সঙ্গে এমন যুক্ত বিবৃতি নজিরবিহীন। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিস্ময় এবং সরকারের প্রতি কিছু ক্ষোভেরও বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখেছি। তা প্রকাশ করেছে জামায়াতে ইসলামী এবং এমনকি সরকার সমর্থক এনসিপি। তবে ইউনূস-তারেক বৈঠকটি সাধারণভাবে রাজনৈতিক মহলে ও বিশেষ করে জনগণের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে। মানুষ সব সময়েই চায় দ্বন্দ্ব-সংঘাত এড়িয়ে আলোচনা-সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতানৈক্যের নিরসন ঘটানো। এদিক থেকে বৈঠকটি অনন্যসাধারণ। 


তবে শুধু নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কে একমত হওয়ার জন্য প্রফেসর ইউনূসের ৩৯ জনের বিরাট বহর নিয়ে লন্ডনে যাওয়ার দরকার ছিল কিনা- এ এক কৌতুকমিশ্রিত লাখ টাকার প্রশ্ন। এটা ঢাকায় বসে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় এবং প্রধান নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে টেলিফোন বা ভিডিও সংলাপে নিষ্পত্তি হওয়ার বিষয়। প্রধান উপদেষ্টা অবশ্য লন্ডন সফরে গেছেন ইংল্যান্ডের রাজা চার্লসের নামে একটি পুরস্কার গ্রহণের দাওয়াতে কিন্তু সেটাকেই ‘সরকারি সফর’ নাম দিয়ে প্রতারণামূলক প্রচারে রাষ্ট্রীয় লোকজন নিয়ে ব্যয়বহুল আয়োজনে। কূটনৈতিক দিক থেকে এই সফর একটি কেলেঙ্কারি হিসেবে বিশ্বে আমাদের দেশকে লজ্জা দিয়েছে। কারণ বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের সঙ্গে বৈঠকের কর্মসূচি চেয়েও তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন এবং ঐ দেশে চার  দিন অবস্থানকালে ন্যূনতম সরকারি প্রটোকল পাননি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকটি বাংলাদেশ চেয়েছিল পাচার হওয়া বিপুল অঙ্কের টাকা উদ্ধারে সহায়তার ইস্যুতে।
ইউনূস-তারেকের বৈঠকটির প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ রাজনৈতিক মহলে আগে থেকেই চলছিল। আমার নিজের একটি পূর্ব-অনুমান যা বৈঠকের অব্যবহিত আগে ফেসবুক পোস্টে প্রকাশ করেছিলাম তা এখানে উল্লেখ করতে চাই। কেননা, এর প্রাসঙ্গিকতা এখনো আছে। আমি লিখেছিলাম, “১৩ই জুন লন্ডনে প্রফেসর ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকটিকে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তা যথার্থ। তবে ‘টার্নিং পয়েন্ট’, ‘ঐতিহাসিক’ প্রভৃতি অভিধায় বিএনপি নেতাদের আগাম উচ্ছ্বাস বা ইউফোবিয়া অতিরিক্ত মনে হচ্ছে।... নির্বাচনের সময়কে কেন্দ্র করে সরকার ও বিএনপি’র মধ্যে যে টানাপড়েন চলছে তাতে সময়টা এপ্রিলের পরিবর্তে ফেব্রুয়ারিতে এগিয়ে এনে সমঝোতা করা খুব কঠিন নয় এবং শুধু এজন্য ঢাকঢোল পিটিয়ে লন্ডনে বৈঠক দরকার হতো না মনে হয়। বরং জুলাই সনদ, তাতে সংসদ-কাম-সংবিধান সভা নির্বাচন তথা ১৯৭২-এর সংবিধান বদলে ফেলে রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তন, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা, পরবর্তী সংসদে অন্তর্বর্তী সরকারের সকল কাজের   বৈধতা, আরাকান করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দর টার্মিনাল ইজারা প্রভৃতি নিয়ে বিএনপিকে আশু সহজে ক্ষমতায় আরোহণের বা ক্ষমতায় নিরুপদ্রব বড় ভাগ দেয়ার লোভ দেখিয়ে একটি ‘ডিল’ বা অঘোষিত সমঝোতা চুক্তি এই বৈঠকের ব্লুপ্রিন্ট হতে পারে। 


এতে রাজি হলে বিএনপি আশু কিছু আম কুড়াতে পারে কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে আম-ছালা দুই-ই যাওয়ার আশঙ্কা এবং আখেরে জামায়াত ও ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা।
বিএনপি’র উচিত হবে জিয়াউর রহমানের আদর্শে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের প্রতি অঙ্গীকার ঠিক রেখে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং ‘চুক্তি’ করে নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনে জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার  চেষ্টায় স্থির থাকা। এতেই বিএনপি’র রাজনীতির বিজয় হবে।”


ইউনূস-তারেক একান্ত বৈঠকে কী আলোচনা বা সাব্যস্ত হয়েছে তা জনগণের এখনো জানার সুযোগ হয়নি। তারা খোলাসা করে বলছেন না। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা লক্ষ্য রাখবেন বিএনপি’র আচরণের দিকে। আগে আপত্তি করলেও ইতিমধ্যে সরকারে বিদেশি নাগরিক বলে কথিত প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের উপস্থিতি বিএনপি মেনে নিয়েছে। করিডোর-ইজারা ইস্যু নতুনভাবে না এলেও বিএনপি সুর নরম করেছে। অবাক করা বিষয় হলো বিএনপি সরকার গঠন করলে প্রফেসর ইউনূসকে রাষ্ট্রের কাজে লাগানো হবে বলে ঘোষণা দেয়া। প্রফেসর নিজে লন্ডনে চাথাম হাউসের গণসাক্ষাৎকারে দুনিয়ার সামনে ঘোষণা করেছেন যে, দেশে পরবর্তী সরকারের সময় রাজনীতিতে তিনি কোনো ভূমিকাই নিতে চান না। একাধিকবার বলেছেন নির্বাচনের পরে তিনি নীরবে চলে যাবেন। সে অবস্থায় বিএনপি’র এই প্রস্তাবটি কি অযাচিতভাবে বিএনপি’র দিক থেকেই ইউনূসের নিরপেক্ষতাকে গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন করে না? অন্তর্বর্তী সরকারের ভূতপূর্ব নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো নিরপেক্ষ হওয়ার কোনো সাংবিধানিক দিব্যি নাই। কিন্তু এই সরকারের অধীনেই যেহেতু নির্বাচন হবে; তাই একে নিরপেক্ষ হতেই হবে। বিএনপি তা ভঙ্গ করতে যায় কেন? 


ফেব্রুয়ারিতে কি নির্বাচন হবেই? এবং মসৃণভাবে হবে? দেশবাসী অবশ্যই আশা করবে। আইনশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক-সামাজিক উত্তেজনা, মব-মানসিকতা, সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক ও পুলিশি সক্ষমতা প্রভৃতি নানা চ্যালেঞ্জ আছে। জুলাই আন্দোলনের শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার বিচার ও শাস্তি, আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখার নিশ্চয়তা, নতুন দল এনসিপি’র ‘নির্বাচন কমিশন পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচনে যাবো না’ বলে নির্বাচনকে ঠেলে পিছিয়ে নেয়ার বিভিন্ন চেষ্টা আছে। একটি চ্যালেঞ্জ কম আলোচিত হচ্ছে। তা হলো ‘জুলাই সনদ’। 
কেন গুরুত্বপূর্ণ? জুলাই আন্দোলনকারী ও সরকারি মহলগুলো থেকে বলা হয়েছে, জুলাই সনদ আসন্ন জুলাই মাসে বা আন্দোলনের বর্ষপূর্তি ৫ই আগস্টের আগে ঘোষণা করা হবে এবং ঐ সনদের আলোকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। 


‘সনদ’ শব্দটা শুরুতে ছিল না। আলোচনাটির আকস্মিক সূত্রপাত ২০২৪ সাল শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে। হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো আন্দোলনকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতা, সরকারে থাকা উপদেষ্টা ও বাইরের নেতারা হঠাৎ ২৮শে ডিসেম্বর ইন্টারনেট সামাজিক মাধ্যমে ঘোষণা করেন যে, ৩১শে ডিসেম্বর শহীদ মিনারে জমায়েত হয়ে ‘প্রোক্লেমেশন অফ জুলাই রেভ্যুলুশন’ ঘোষণা করা হবে। তারা ইংরেজিতে বলতে পছন্দ করেন। যেমন আন্দোলনের কর্মসূচিগুলো ‘ঢাকা ব্লকেড’, ‘টোটাল শাটডাউন’, ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ প্রভৃতি নাম দিতেন। তেমনি ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলেন। যা-হোক, সংবাদমাধ্যমে নতুনটির বঙ্গানুবাদে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ বলে চালু হয়। তখন যে রাজনৈতিক পটভূমি ছিল তা হলো এই আলোচনা যে, ৫ই আগস্ট ক্ষমতা দখলের পরে দেশের সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ঠিক হয়নি, বিপ্লব ঘোষণা দিয়ে সংবিধান বাতিল করে সর্বময় ক্ষমতা  নেয়া উচিত ছিল। আন্দোলনের সমন্বয়ক ও প্রবাসী ইউটিউবার প্রভাবক কেউ কেউ এজন্য প্রফেসর নজরুল প্রমুখকে দোষারোপ করেও বলতে থাকেন। কবি চিন্তক ফরহাদ মজহার প্রমুখ কয়েকজন জোরালোভাবে বিপ্লবের তত্ত্ব তুলে ধরেন। ছাত্র নেতারা রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ ও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করাকে  অসমাপ্ত বিপ্লব সম্পন্ন করার উপাদান হিসেবে নিয়ে আন্দোলনে নামেন। একজন ছাত্র উপদেষ্টা সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, ‘নাউ অর নেভার!’ তখন এনসিপি’র জন্ম হয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল জুলাই প্রোক্লেমেশনের মাধ্যমে  ‘আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করা হবে এবং একই সঙ্গে ১৯৭২ সালের মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচনা করা হবে।’ তখন প্রফেসর ইউনূস বিচক্ষণতার সঙ্গে ওই ছাত্রদের বিপ্লবী উন্মাদনা প্রশমিত করে আনেন তার প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে দিয়ে এই ঘোষণার মাধ্যমে যে সরকার চলমান প্রক্রিয়ায় সকল রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তির সঙ্গে আলোচনা করে ব্যাপক ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণার ব্যবস্থা করবে। সেটা বেশি ফলপ্রসূ হবে। উগ্র ছাত্র নেতারা এটা মেনে নিতে বাধ্য হন, শহীদ মিনারের সমাবেশকে  প্রোক্লেমেশন থেকে বিরত রেখে তা ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ হিসেবে নিয়ে পরে জুলাই সনদের একটি খসড়ার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার সূত্রপাত করা হয়। রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের জন্য গঠিত কয়েকটি কমিশনের প্রস্তাবগুলো নিয়ে ইউনূসের সভাপতিত্বে গঠিত ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যে আলোচনা কয়েক মাস ধরে চালাচ্ছে তারই অংশে পরিণত করা হয়েছে জুলাই সনদকে। যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে সেগুলো নিয়ে সনদটি প্রস্তুত হবে। এখনো কয়েকটি বড় বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। ঐকমত্য কমিটির সহ-সভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ চেষ্টা চালাচ্ছেন। ইতিমধ্যে আন্দোলনকারী ছাত্র-তরুণদের একাংশের মধ্যে বিপ্লবী উন্মাদনা কমে এলেও এবং সরকারিভাবে ‘বিপ্লব’ না বলে ‘গণ-অভ্যুত্থান’ বলা চালু হলেও জুলাই সনদের বিষয়বন্তু নিয়ে, বিশেষত দেশের সংবিধান প্রশ্নে কোনো মহল যাতে বিভেদাত্মক বক্তব্য প্রদান ও ভূমিকা গ্রহণ না করতে পারে সেদিকে সরকারসহ সকলের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কোনো অজুহাতে নির্বাচনকে পিছিয়ে দেয়া বা রাজনৈতিক সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির দিকে দেশকে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা যাতে কোনো মহল না করতে পারে সে-বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। জুলাই ঘোষণা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করুক, বিভক্ত নয়। 

মতামত'র অন্যান্য খবর