খো লা ক ল ম

আমজনতা কেন রাজনীতি বোঝে না?

মাসুদ কামাল | মতামত
জুন ২১, ২০২৫
আমজনতা কেন  রাজনীতি বোঝে না?

লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠকের পর দেশের রাজনীতিতে বড় একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বৈঠক শেষে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে পাশে বসিয়ে একটা যৌথ বিবৃতি পাঠ করেছেন সরকারের নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান। ছোট্ট বিবৃতি। সেখানে নির্বাচন বিষয়ক কিছু অস্পষ্ট কথা ছাড়া আর তেমন কিছু ছিল না। আর সেটা নিয়ে সেখানে বসেই বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির এই সদস্য ‘সন্তুষ্টি’ প্রকাশ করেছেন। এই সন্তুষ্টির প্রতিফলন আমরা দ্রুতই দেখতে পেলাম বিএনপি’র রাজনীতিতে। মির্জা ফখরুল থেকে শুরু করে সকল নেতার কথাবার্তাতেই সরকারের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশিত হতে থাকলো। এ প্রবণতা চলছে এখনো। দু’দিন আগে দেখলাম মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন-‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা অনেকের পছন্দ হয়নি।’ তার এমন কথা যে জামায়াত বা এনসিপি’র উদ্দেশ্যে বলা-এমনটি ধারণা করা যায়। তারেক রহমানের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠকের পর এই দু’টি দল কিছুটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। সে কারণেই হয়তো মির্জা আলমগীরের এমন বক্তব্য। 


কিন্তু যে বিষয়টা আমি বুঝতে পারছি না, সেটা হলো-মির্জা সাহেব ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন’ পেলেন কোথায়? লন্ডন বৈঠকে কী এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে? এমন কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা কী এসেছে? 
আমরা বরং যৌথ বিবৃতিতে আসলে কী বলা হয়েছে সেটা আরও একবার দেখে নিতে পারি। নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে সেখানে মূলত তিনটি প্রসঙ্গ আছে। এক. “জনাব তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও মনে করেন ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়”। দুই. “প্রধান উপদেষ্টা বলেন যে, তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে”। এবং তিন. সেক্ষেত্রে অবশ্য, “সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।”
বিএনপি এতদিন ২০২৫-এর ডিসেম্বর বা এর আগে নির্বাচনের দাবি করে আসছিল। ধারণা করা হয়েছিল লন্ডন বৈঠকে তারেক রহমান হয়তো সেই ডিসেম্বর নিয়ে কোনো আপস করতে চাইবেন না। কিন্তু যৌথ বিবৃতির ভাষা অনুযায়ী মনে হচ্ছে ডিসেম্বর থেকে দুই মাস পিছিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবটা তারেক রহমানের কাছ থেকেই এসেছে। এটা তারেক রহমান সাহেব নিজেই চেয়েছেন নাকি তার মায়ের প্রভাবে চেয়েছেন- সেটা বলা মুশকিল। তবে বিবৃতিতে বেগম খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ করায় অনেকের মনে দ্বিতীয় সম্ভাবনার কথাটা আসবে। 


মির্জা ফখরুলের সেই ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন’ এর দাবিটি কতোটুকু তথ্যভিত্তিক, সেটা বিচার করতে আমরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় পয়েন্টের দিকে তাকাতে পারি। দ্বিতীয় পয়েন্টের শুরুতেই প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত এপ্রিল মাসের কথা আবারো উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে- তবে রমজানের এক সপ্তাহ আগেও হতে পারে যদি সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে ‘সকল প্রস্তুতি’-এটা কে সম্পন্ন করবে? তৃতীয় পয়েন্টে যেয়ে আবার আরও একটা শর্তের কথা বলা হয়েছে। সেটা হচ্ছে সংস্কার ও বিচার বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি। আসলে এই সকল শর্তই একটু বেশি মাত্রায় অস্পষ্ট। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো কি-না, সংস্কার ও বিচার বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হচ্ছে কি-না, এসব নির্ধারণ কে করবে? অথবা এসব করার দায়িত্বই বা কার? আসলে সবকিছুই অস্পষ্ট। রমজান শুরু হবে সম্ভবত ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারির ১৮ বা ১৯ তারিখ। রমজানের এক সপ্তাহ আগে বলতে ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখকে ধরা যেতে পারে। সে কারণেই বিএনপি হয়তো ধরে নিয়েছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। কিন্তু যে সকল ‘যদি’ এবং ‘তবে’র কথা বলা হলো, তার উপর নির্ভর করে ফেব্রুয়ারি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার কোনো সুযোগ আছে? 
তবে আমাদের যতই দ্বিধা থাক না কেন, বিএনপি’র আচরণ দেখে মনে হচ্ছে ফেব্রুয়ারি বিষয়ে তারা খুবই নিশ্চিত। হয়তো তারা ওই বৈঠকের বিষয়ে এমন কিছু জানে, যা আমরা সাধারণ নাগরিকরা জানি না। এটাও খুবই সম্ভব। আচ্ছা ভাবুন, তারেক রহমানের সঙ্গে ড. ইউনূসের একান্ত বৈঠক হয়েছে পুরো দেড় ঘণ্টা। দেড় ঘণ্টা একেবারে কম সময় নয়। এই সময়ে তারা কি কেবল নির্বাচনের তারিখ নিয়েই কথা বলেছেন? আর কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলেননি? নিশ্চয় বলেছেন। তারেক রহমান তার মায়ের বরাতে প্রস্তাব দিলেন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে, ড. ইউনূসও তাতে রাজি হলেন, ব্যস এতটুকুই? বাকি সময় দু’জন কি চুপচাপ বসেছিলেন? তাহলে আর কী কী কথা হয়েছে? আমরা সাধারণ জনগণ জানি না। কেউ কি জানে? বিএনপি’র নেতারা কি জানেন? মনে হয় না। তাহলে কি এটাকে গোপন বিষয়ের বৈঠক বলা যায়? তবে আমরা সাধারণ মানুষ কিন্তু জানতে চাই। আমরা বুঝতে চাই, এমন অস্পষ্ট বিবৃতির পরও বিএনপি’র নেতারা কেন এত খুশি। কেন এক সপ্তাহেই তারা দুই দুইবার ঈদ উদ্‌যাপনের মতো খুশি হয়ে ওঠলেন? 


আচ্ছা, ওই দেড় ঘণ্টার অপ্রকাশিত আলোচনার মধ্যে কি ড. ইউনূসকে পরবর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট করার বিষয়টি আছে? কেউ কেউ হয়তো বলবেন-এই প্রশ্নটি আসছে কেন? লন্ডনের চ্যাথাম হাউজে ড. ইউনূস তো স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, আগামী সরকারে তিনি কোনো দায়িত্বে থাকবেন না। তাহলে আর এনিয়ে প্রশ্ন কেন? না, ড. ইউনূসের স্পষ্ট উচ্চারণের পরও একই বিষয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে। উনি তো একাধিক বিদেশি মিডিয়াকে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, তাদের সরকারের কোনোই ইচ্ছা নেই কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার। সেই কথায় কি তিনি শেষ পর্যন্ত থাকতে পেরেছেন? কে জানে হয়তো আগামী কোনো প্রবল অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করতে না পেরে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে নেবেন। 
এ প্রসঙ্গে বিএনপি’র আর একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের একটা উক্তিকে স্মরণ করা যেতে পারে। ক’দিন আগে তিনি স্থানীয় একটা পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘আমরা ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শকে কাজে লাগানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছি।’ এই আগ্রহ ওনারা কার কাছে প্রকাশ করেছেন? নিশ্চয়ই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে? কখন প্রকাশ করলেন? লন্ডন বৈঠকের ওই দেড় ঘণ্টায়? হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। তবে যখন আমরা বৈঠকের আলোচনা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানতে না পারবো, তখন নেতাদের এরকম কিছু কথাকে কেন্দ্র করে আমাদের কল্পনার রথ চলতেই থাকবে। 


গেল সপ্তাহে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির একটা সভা হয়েছে। সেখানে তারা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, ড. ইউনূস সরকারের ওপর তারা আস্থা ও বিশ্বাস রেখে চলবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কী তারা আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইউনূস সরকারের সকল কাজেই নিঃশর্ত সমর্থন দেবে? এই যে সরকারের একজন উপদেষ্টা বিএনপি’র ইশরাক হোসেন কর্মকাণ্ডকে ক্রিমিনাল অফেন্স বলে অভিহিত করছে, বিএনপি কি তাতেও সমর্থন দেবে? অথবা চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে লিজ দেয়া নিয়ে এতদিন বিএনপি যে আপত্তি করেছে, সেটা আর থাকবে না? বিষয়গুলো আসলেই কনফিউজিং। টার্মিনাল নিয়ে এতদিন বিএনপি যে আপত্তি করেছিল সেটা তাদের দলীয় স্বার্থে নাকি জনগণের স্বার্থে? তাহলে কি তারা দলীয় প্রাপ্তির বিনিময়ে জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেবে? আবার ধরুন সেই নির্বাচনের তারিখের বিষয়টিই। এতদিন তারা যে ডিসেম্বরের কথা বলছিল সেটা কি কোনো যৌক্তিক কারণে নাকি নিছকই বলার জন্য বলা ছিল? যদি যৌক্তিক কারণে হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই সেই যুক্তি ছিল জনগণের সুবিধা ও স্বার্থকে বিবেচনায় রেখেই। এখন ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিতে গেল তারা কোন যুক্তিতে? সেই যুক্তিটা কি তারা জনগণের সঙ্গে শেয়ার করেছে? কেন করছে না?
নাহ, বুঝি না ভাই, বুঝি না। আমরা আমজনতা আসলে রাজনীতিই বুঝি না। 

মতামত'র অন্যান্য খবর