প্র চ্ছ দ প্র তি বে দ ন

লন্ডন বৈঠকের আগে-পরে

মিজানুর রহমান | এক্সক্লুসিভ
জুন ২১, ২০২৫
লন্ডন বৈঠকের আগে-পরে

নানা কারণে বৈঠকটি হওয়া জরুরি ছিল। উভয়ের আগ্রহ এবং আন্তরিকতায় এটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গেছে লন্ডনের অভিজাত হোটেল ডরচেস্টার। সেখানে উপস্থিত লোকজনের চোখ এবং ক্যামেরার লেন্সও। আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের রাজনীতির গতিমুখ পাল্টে দেয়া বৈঠক এটি। বৈঠকটির নেপথ্য কারিগরদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তথা রাজনীতি সচেতন একজন সংবাদকর্মী হিসেবে এটা আমার মূল্যায়ন। বোদ্ধাদের তরফে যুক্তি, পাল্টা যুক্তি আসবে, আসছে। হিসাব মিলাবে ‘সময়’। আপাতদৃষ্টিতে বিএনপি’র সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতা হয়ে গেছে ১৩ই জুন লন্ডনে অনুষ্ঠিত ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকে। জনশ্রুতি আছে রাজনীতির জীবন্ত কিংবদন্তি বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও কথা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। তবে সেই ফোনালাপের দিনক্ষণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এটি বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের আগে, পরে বা উপস্থিত মুহূর্তে হয়েছে কিনা- তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য রয়েছে। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, সেই আলোচনার পর ১৮০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতি। বিশেষ করে বৈরী বিএনপি এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় সমর্থক! আর দূরে সরে গেছে এতদিন সরকারের পক্ষে থাকা জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন এবং অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেয়া রাজনৈতিক শক্তি এনসিপি। জুলাই বিপ্লব না হলে প্রধান উপদেষ্টার আসন দূরে থাক, স্থান হতো কারাগারের কোনো নীরব কক্ষে- এমনটা ড. ইউনূস নিজেই বলেছেন। যাক, হাসিনা লীগ ছাড়া ৩৬ জুলাই’র রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে বিএনপি, জামায়াতসহ দেশের গণতন্ত্রকামী সব পক্ষের সমর্থন ছিল। অনেকে অনেকভাবে এতে সহায়তা দিয়েছেন। হয়তো সেই অর্থে তারা রাজপথে রক্ত ঝরাননি। লন্ডন বৈঠককে স্বাভাবিক বললেও এর আউটকাম তথা যৌথ ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। তাদের সন্দেহ জুজুর ভয়ে ড. ইউনূস সরকার আচমকা বিএনপি’র দিকে হেলে পড়েছে! অবশ্য এ নিয়ে সরকারের তরফে এখনো খোলাসা করে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। 


বিশ্লেষকরা বলছেন- জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্বের মূলে ছিল নির্বাচন প্রশ্নে অবিশ্বাস। দু’পক্ষের মাঝে জমে ছিল ঘন কালো মেঘ। কিছু লোক সরকার ও বিএনপি’র স্বাভাবিক সম্পর্ককে বিষিয়ে তুলছিল পরিকল্পিতভাবে। তাদের টার্গেট ঘোলা পানিতে মাছ শিকার! এ জন্য সেনা নেতৃত্বকেও পক্ষভুক্ত করার অপচেষ্টা হয়। সব মিলিয়ে গত ক’মাসে সরকার ও বিএনপি’র মধ্যকার দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে। যার প্রভাব পড়ে সরকারের কাজকর্ম এবং গতিতে। পুরো বিষয়টিকে বেশ জটিল রূপ দিতে সক্ষম হয় দুরভিসন্ধিতে মত্ত স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত তারা সফল হতে পারেনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিচক্ষণতায় যড়যন্ত্রকারীদের সেই কূটকৌশল ভেস্তে গেছে। সরকারপ্রধান এবং বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলোর দাবি- ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকের আগে কয়েক মিনিট ছিল দু’পক্ষের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ফটোসেশন। তাতে ক্যামেরার সামনেই তাদের আন্তরিকতাপূর্ণ বাক্যবিনিময় হয়। 


আনুষ্ঠানিক বৈঠকে পারস্পরিক জানা-বোঝার সুযোগ হয়েছে জানিয়ে উভয়ের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানিয়েছে- যোগাযোগের ধারাবাহিকতায় একান্ত বৈঠকে বসেন ড. ইউনূস ও তারেক রহমান। বৈঠকের সূচনা এবং সমাপনীর আনুষ্ঠানিকতা বাদে পিওরলি একঘণ্টা একান্তে কথা হয় তাদের মধ্যে। বিষয়টি এতটাই একান্ত ছিল, যেন তাদের বৈঠককক্ষের দেয়ালের কানও বন্ধ করে দেয়া হয়! তবে হ্যাঁ, তারা উভয়ে বৈঠকের আগে-পরে সংশ্লিষ্টদের নানা বিষয়ে ডিক্টেশন দিয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতেই অবিশ্বাস্য দ্রুততায় নজিরবিহীন যৌথ ঘোষণা আসে। বৈঠকটি আয়োজনে বিশেষ করে এটি অর্থবহ করতে অনেককে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সেই তালিকা দীর্ঘ। সূত্র এটা নিশ্চিত করেছে যে, উভয়ের ঘনিষ্ঠ এবং কল্যাণকামী দেশি-বিদেশি কূটনীতিক, সরকারের অন্তত দু’জন উপদেষ্টা এবং চূড়ান্ত বিচারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তারেক রহমানের আন্তরিকতায় দূরত্ব ঘুচিয়ে বৈঠকটির আয়োজন সম্ভব হয়েছে। সূত্রের ভাষ্য ছিল এমন, ‘দৃশ্যত প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও বিএনপি’র তরফে লন্ডন বৈঠকের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এটা অস্বীকারের জো নেই যে, উভয় পক্ষের দূরত্ব ঘোচাতে বিশেষ করে নির্বাচন প্রশ্নে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের একজন সিনিয়র উপদেষ্টা, উভয়ের পছন্দের আমেরিকা মহাদেশে চুক্তিতে নিযুক্ত একজন রাষ্ট্রদূত (যিনি ক’দিন আগে ঢাকায় বিভিন্ন পর্যায়ে সিরিজ বৈঠক করে গেছেন), আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন ফটোসাংবাদিক এবং তারেক রহমানের বিশ্বস্ত সহযোগী একজন ব্যারিস্টার। তারা দিন-রাত খেটেছেন। লন্ডন এবং ঢাকার টাইম জোনের ব্যবধানকে বিবেচনায় রেখে তারা উভয়ের মধ্যে বার্তার আদান-প্রদানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার কঠিন সময় পার করেছেন। তারা মিটিং আয়োজনের চেয়ে ফলাফলকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। 


সূত্রের দাবি- রাজনীতি তথা সমঝোতার জন্য যুগান্তকারী এমন বৈঠক আয়োজনে সাধারণত বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব থাকা কাছের বা দূরের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা থাকে। গত পাঁচ দশকে তা-ই হয়েছে। কিন্তু এবার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। মধ্যপ্রাচ্যের একটি বন্ধু রাষ্ট্রের সক্রিয়তা বাদ দিলে পুরোটাই হয়েছে হোমগ্রোন। তবে ওই বৈঠকে সেই প্রভাবক বিদেশি শক্তিগুলো অখুশি নয় বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, লন্ডন বৈঠক বাদ দিলে ড. ইউনূসের বৃটেন সফরের কী থাকে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ রাজার নামে প্রতিষ্ঠিত একটি ফাউন্ডেশন থেকে দেয়া অ্যাওয়ার্ড গ্রহণের জন্য সফরটি জরুরি ছিল না। তবে হ্যাঁ, ৫৪ বছরের ইতিহাসে রাজদরবারে ড. ইউনূস বিরল সম্মান পেয়েছেন। কিং চার্লস থ্রি তাকে যে অডিয়েন্স দিয়েছেন তা অভূতপূর্ব। বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের জীবনে এমনটি ঘটেনি। সমালোচকরা অবশ্য সেটাকে কাউন্টার করছেন- দেশটির প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ঘোষিত বৈঠক বাতিল হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে। তারা বলছেন- বৃটেনের তরফে যদি সত্যিকার অর্থে ড. ইউনূসের সফরকে ‘অফিসিয়াল ভিজিট’-এ উন্নীত করা হতো তাহলে কেন এমন হলো? প্রভাবশালী বৃটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস তো খবর দিয়েছে স্যার কিয়ের স্টারমার বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টাকে সাক্ষাৎ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সূত্রের খবর দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীও সে পথেই হেঁটেছেন। যদি সূত্রের দাবি সত্য হয় তাহলে সফরটি আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সম্মানজনক ছিল না। 

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর