গত বছর আগস্টে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেয়ার পর শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে ১০ মাস সময় পার করেছে। তাদের মধুচন্দ্রিমা অনেক আগেই শেষ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব নিতে চাইবে।
আশা করা গিয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার যত দ্রুত সম্ভব রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজটি সম্পন্ন করবে। বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের পরিধি কিংবা নির্বাচনের দিনক্ষণ-কোনো বিষয়ে একমত হতে পারছে না।
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে আগামী বছর এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। কেবল জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়া নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এপ্রিলের সময়সূচিকে স্বাগত জানিয়েছে।
কেবল নির্বাচন নয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনকে শপথ না পড়ানোসহ অনেক বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপি’র দূরত্ব বাড়ছিল। এ অবস্থায় বিএনপি মাঠে আন্দোলন করারও ঘোষণা দিয়েছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডনে বৈঠক করলেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে। বৈঠক শেষে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব। এরপর নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে জটিলতা ছিল, তা অনেকটা কেটে যায়। তবে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রদের নতুন দল এনসিপি লন্ডন বৈঠককে সুনজরে দেখেনি। তাদের নাখোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার বৈঠকে। জামায়াত প্রথম দিনের বৈঠক বর্জন করে। দ্বিতীয় দিনে জামায়াত নেতাদের বক্তৃতায় ক্ষুব্ধ হয় সিপিবিসহ কয়েকটি দল।
অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব নেয় তখন দেশে এক নৈরাজ্যকর অবস্থা চলছিল। জনপ্রশাসন প্রায় অকেজো, পুলিশ বাহিনী নিষ্ক্রিয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মহাবিশৃঙ্খল অবস্থা। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল। এরপর ভেঙে পড়া অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন, রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার, জুলাই-আগস্টের হত্যাকারীদের বিচারকে অগ্রাধিকার দিতে হয়েছে।
সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার অনেকগুলো কমিশন করে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন বিষয়ক কমিশন। সংবিধান সংস্কার নিয়ে কমিশন যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সভা বা গণ-পরিষদ গঠন করতে হবে। কিন্তু বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। তারা বলেছে, যেখানে গত তিনটি নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি, সেখানে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করাই বড় সংস্কার।
বিচার প্রক্রিয়া নিয়েও জনমনে প্রশ্ন আছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের যেসব নেতা জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িত, যারা দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থ পাচার করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা নিলে কেউ আপত্তি করতেন না। কিন্তু যখন আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিসেবীসহ আওয়ামী লীগের শত শত নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ঢালাও হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে, তখন এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। যেই বিতর্কিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছিল, সেই আইনেই আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সম্প্রতি জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রধান ফালকার টুর্ক অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক (অপরাধ) আদালতে দল নিষিদ্ধ করার বিধান জারি হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর অপরাধের বিচারের পাশাপাশি জাতীয় রিকনসিলেশন বা পুনঃএকত্রীকরণের কথাও বলা হয়েছিল। সম্প্রতি আইন উপদেষ্টা ও প্রধান বিচারপতি দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে এসেছেন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে। ৫৪ বছর ধরে যে বিভক্তির রাজনীতি চলে আসছে, তার অবসান কীভাবে হবে সেটাই দেখার বিষয়।
আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধীপক্ষকে ঘায়েল করতে বিরোধী দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল। এর আগে বিএনপি সরকারের আমলেও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হযরানিমূলক মামলা দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ‘বিএনপি-জামায়াত’ ট্যাগ লাগানো হতো। এখন ‘আওয়ামী দোসর’ নামে ট্যাগ লাগানো হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রথম ভাষণে বলেছিলেন, ‘গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকারপ্রধান দেশ ত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটাই-উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার। আমাদের এক লক্ষ্য। কোনো ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যাহত করতে না পারে, সেজন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
কিন্তু সরকারের কার্যক্রমে সেই ‘এক পরিবার দর্শন’ প্রতিফলিত হয়নি। সরকার নির্বাচন, সংবিধান, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার- ছয়টি বিষয়ে যে কমিশন গঠন করেছিল, তাতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। নারী সদস্যও ছিলেন তুলনামূলক কম।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম ও দ্বিতীয় দফা আলোচনায় সরকার বিভক্তি কমাতে পারেনি। বিএনপি ও বামপন্থি দলগুলোর দাবি, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যেটুকু সংস্কার দরকার, অন্তর্বর্তী সরকার সেটুকু করবে। অন্য সংস্কারগুলো করবে নির্বাচিত সরকার।
নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে যে অনিশ্চয়তা চলছে, তার ছাপ অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যেও পড়েছে। মাস কয়েক আগে সরকার মহাসমারোহে বিনিয়োগ সম্মেলন করলেও দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। তারা নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় আছে।
গত ১০ মাসে সরকারকে সবচেয়ে বেশি বিব্রত করেছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি র?্যাব, বিজিবি ও সেনা সদস্যরাও মোতায়েন আছে। তারপরও অপরাধ কমছে না। থেমে থেমে সংঘবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। প্রশাসন ও পুলিশের ওপরও সরকারের কর্তৃত্বও দুর্বল। যেখানে যে রাজনৈতিক দলের প্রভাব বেশি, প্রশাসন ও পুলিশ তাদের কথামতো কাজ করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপি’র নেতৃত্বের মধ্যে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, ধারণা করা যায় লন্ডন বৈঠকে তা অনেকটা কেটে গেছে। কিন্তু অন্যদের কীভাবে অন্তর্বর্তী সরকার সামাল দেবে, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুরু থেকে সরকারের কার্যক্রমে দোদুল্যমানতা লক্ষ্য করছে। তাদের কার্যক্রমে মনে হয় কখনো তার ডান দিকে ঝুঁকে পড়েছে, কখনো বাম দিকে। কিন্তু অরাজনৈতিক সরকার হিসাবে তাদের কর্তৃব্য ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকা।
১০ মাস বয়সী অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা বিচার করতে হবে আমাদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে। অতীতে আমাদের নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত সরকারগুলো কী করেছে, তা-ও মনে রাখতে হবে।
মুহাম্মদ ইউনূস যাদের নিয়ে সরকার গঠন করেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন রাজনীতি ও প্রশাসনের বাইরের মানুষ। স্বাভাবিকভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় তাদের পদে পদে হোঁচট খেতে হচ্ছে। বয়স, অভিজ্ঞতার কারণেও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সবার কাজের দক্ষতা একই রকম নয়। কয়েকজন নিজের মন্ত্রণালয় চালানোর বিষয়ে সক্রিয়তা দেখালেও অন্যদের এ বিষয়ে দৃষ্টিকটু পর্যায়ে ঘাটতি আছে।
বাংলাদেশে এর আগে যতগুলো রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, তার পেছনে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। পার্থক্য হলো, ৫ই আগস্টের পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর ইতিবাচক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও তারা বেসামরিক প্রশাসনে নাক গলায়নি। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বারবার বলেছেন, ক্ষমতায় আসার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই।
গত বছর আগস্টে যে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, ১০ মাস পরও সেই অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা কমবেশি রয়ে গেছে। তারা কোনো বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারেনি। রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে এক ধরনের ডানপন্থার উত্থান ঘটেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা আরও প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন। অনেকে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরোধিতা করতে গিয়ে একাত্তরকেও অস্বীকার করছেন।
১০ মাসে সরকারের কার্যক্রম দেখে মনে হয়, কোন বিষয়ে তারা স্থির থাকতে পারছেন না। যখন যেই দল বা গোষ্ঠী চাপ দেয়, তাদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে। এ কারণে তারা কখনো ডানে হেলে পড়ে, কখনো বামে। অনেকটা পেন্ডুলামের মতো দুলছে সরকার।
লন্ডন বৈঠকের আগে মনে হতো সরকার এনসিপি ও জামায়াতের পক্ষে আছে। সেই অপবাদ ঘুচানোর জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে লন্ডনে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে যৌথ বিবৃতিও দিতে হলো। এখন জামায়াতে ইসলামী বা এনসিপি যদি গোসসা করে তাদের দোষ দেয়া যায় না। অন্তর্বর্তী সরকারকে চলতে হবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে। এখানে রাগ অনুরাগের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। সরকারের দোদুল্যমান অবস্থান কেবল তার গ্রহণযোগ্যতাই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, আগামী নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।