জুলাইয়ের মধ্যে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে। জুলাইয়েই সনদটি ঘোষণা করতে হবে- এমন কোনো কথা অবশ্য নেই। যত দ্রুত সম্ভব এটি ঘোষণা করা দরকার। এতে সংস্কারের বাছাইকৃত সুপারিশ বিষয়ে মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি, আংশিক সম্মতি ও অসম্মতি তুলে ধরা হবে। তাদের প্রতিনিধিরা এতে স্বাক্ষর করবেন বলেও জানানো হয়েছে। শুধু একটি নির্বাচন করে ক্ষমতা হস্তান্তরই অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা রাষ্ট্র সংস্কারের অন্তত সূত্রপাত ঘটানোটাও এ সরকারের কাজ বলে মনে করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কোনোটাই বলছে না যে, সংস্কারের কোনো প্রয়োজন নেই। বরং এমনটিই মনে করা হচ্ছে, সংস্কারে অগ্রগতি হয়নি বলেও গণতন্ত্র এখানে ঠিকভাবে কাজ করেনি; সেখান থেকে স্বৈরতন্ত্রেরও উত্থান হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মতো বিপরীতমুখী সংস্কারও হয়েছে এদেশে। তাতে নানান সীমাবদ্ধতার মাঝেও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যেটুকু অগ্রগতি আনা গিয়েছিল, সেটিও ধ্বংস হয়ে যায়। এ কারণে গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে এমনটিও বলা হচ্ছে, আর কোনো সংস্কার করা না গেলেও নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে। যেসব কমিশনের বাছাইকৃত সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক চলছে, তাতে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোও পাচ্ছে গুরুত্ব।
কোন ক্ষেত্রে সংস্কার বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। সংস্কারের বাছাইকৃত সুপারিশ ঘিরে মতপার্থক্যও কম নয়। ঐকমত্যও রয়েছে অনেক বিষয়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য তো স্বাভাবিক। মতপার্থক্য বহাল থাকবে, এমনটি মনে করারও কারণ নেই। আশার কথা, দলগুলোর মধ্যে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই গঠন করা হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এর প্রধান। প্রথম দফার গঠিত ছয় সংস্কার কমিশনের প্রধান রয়েছেন এর সদস্য হিসেবে। কমিশনের মেয়াদ ছয় মাস। জুলাইয়ের মধ্যে সনদ ঘোষিত হলে ছয় মাসেই এর কাজ সম্পন্ন হবে। সে লক্ষ্যে দ্বিতীয় দফা সংলাপ চলছে। ঈদুল আজহার পর এ কাজে অগ্রগতিও হচ্ছে পরিলক্ষিত।
প্রথম দফা সংলাপে যেসব সুপারিশে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সেগুলোর মধ্যে বিশেষ করে মৌলিক সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক জায়গায় আনার চেষ্টায় দ্বিতীয় দফা সংলাপ পরিচালিত হচ্ছে। ‘মৌলিক সংস্কার’ বলতে সাংবিধানিক সংস্কারের সুপারিশগুলোর কথাই বোঝাচ্ছে ঐকমত্য কমিশন। নিবন্ধটি লেখার সময় এ সংক্রান্ত কয়েকটি সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক হচ্ছে। সংলাপ শেষে তাদের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখছেন মিডিয়ার সামনে। এমন পরিস্থিতি এই প্রথম দেখা যাচ্ছে দেশে। মৌলিক কিছু সংস্কার নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলো ভাবছে এবং অন্তর্বর্তী সরকার সে ক্ষেত্রে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করছে, এটা উৎসাহব্যঞ্জক বৈকি। সংলাপের ভেতর দিয়ে তারা কিছু ক্ষেত্রে পরস্পরের নিকটবর্তী হচ্ছে, এটাও লক্ষণীয়। তাদের মধ্যে যৌক্তিক প্রশ্নে ছাড় দেয়ার প্রবণতাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
দু’-একটি উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে। যেমন, সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি থেকে সরে আসার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। তবে জাতীয় সংসদের দুই কক্ষের সদস্যরাই কেবল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন, নাকি স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরাও এতে যোগ দেবেন, তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। নিবন্ধটি প্রকাশিত হতে হতে এ ইস্যুতে ঐকমত্যও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারে। আর এ প্রক্রিয়ায় আমরা একজন সর্বজনগ্রাহ্য রাষ্ট্রপতি লাভের সুযোগ পাবো বলেই মনে করা হচ্ছে। এমন একজন রাষ্ট্রপতির হাতে বাড়তি কিছু ক্ষমতা প্রদানের বিষয়ও আলোচনাধীন। দ্বিতীয় উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো সংসদের দ্বিতীয় কক্ষের বিষয়ে এরই মধ্যে একমত। তবে এর সদস্যরা কীসের ভিত্তিতে আসবেন, সে ব্যাপারে রয়েছে মতপার্থক্য। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনের ব্যাপারে একটি বড় দলের আপত্তি রয়েছে। দেখা যাক, শেষতক কী ঘটে! তৃতীয় উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বহুল আলোচিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের তুলনামূলক স্বাধীনতা নিশ্চিতের প্রশ্নে অগ্রগতি এসেছে। অর্থবিল পাস ও আস্থা-অনাস্থা ভোট বাদে আর সব বিষয়ে তারা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবেন বলে দলগুলো নাকি একমত। এগুলোকে কম অগ্রগতি বলা যাবে না। সুশীল সমাজেও এসব প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছিল। রাজনৈতিক দলগুলোও এখন এসব নিয়ে ভাবতে এবং পরস্পরের কাছাকাছি এসে কাজ করতে শুরু করেছে।
দ্বিতীয় দফা সংলাপ চলতি মাসেই শেষ করার প্রয়াস রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। অতঃপর এটাও স্পষ্ট হবে, কতোখানি সংস্কার বর্তমান সরকারের আমলে সম্পন্ন হবে আর নির্বাচিত সরকারের আমলে কতোখানি। কী প্রক্রিয়ায় সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়িত হবে, সেটাও জুলাই সনদে স্পষ্ট করা হবে। সবকিছুই হবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে। একথা প্রধান উপদেষ্টা শুরু থেকে বলে আসছেন। তার নেতৃত্বাধীন সরকার কতোদিন থাকবে, সেটাও ‘রাজনৈতিক আলোচনা’য় স্থির হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নির্ভর করছে সংস্কারের পরিমাণ ও গতির ওপর, একথাও বলেছিলেন তিনি। অল্প সংস্কার ও বেশি সংস্কারের কথাটি সেভাবেই সামনে আসে। তবে এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে জানিয়েছেন, এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন করে বিদায় নেবে সরকার। ‘নির্বাচনের রোডম্যাপ’ সুস্পষ্ট করার দাবির প্রেক্ষাপটেই এটি জানানো হয়েছে।
ওই ঘোষণার কিছুদিন পরই লন্ডনে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ ঘোষণায় জানানো হয়, বিচার ও সংস্কারে ‘পর্যাপ্ত অগ্রগতি’ আনা গেলে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেও নির্বাচন করা যেতে পারে। রমজান শুরুর আগেই নির্বাচন সেরে ফেলা উচিত বলে মত জোরালো হয়ে ওঠাতেই এমন সম্ভাবনার কথা জানানো হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকার ও বিএনপি’র মতো গুরুত্বপূর্ণ দু’পক্ষের মধ্যে ঐতিহাসিক সমঝোতা বলেও গণ্য করা হচ্ছে এটাকে। তবে লক্ষণীয়, এক্ষেত্রেও সংস্কারের বিষয়টিকে রাখা হয়েছে শর্ত হিসেবে। জুলাই আন্দোলন দমনে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য অভিযুক্তদের বিচারকে একটা পর্যায় পর্যন্ত আনার শর্তও এক্ষেত্রে রয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো কোনো সংস্কার না চাইলে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেয়া হবে, এটাও ছিল প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা। দলগুলো কোনো সংস্কার চায় না কিংবা কোনো সংস্কারের বিষয়ে একমত নয়, এমনটা তো বলা যাবে না। মাঠে থাকা সব রাজনৈতিক দলই সংস্কার বিষয়ে কমবেশি আগ্রহী। সংবিধান সংস্কারের প্রশ্নেও কোনো দল পুরোপুরি অনাগ্রহী নয়। কোনো কোনো পক্ষ হয়তো বলছে, এ সংক্রান্ত পরিবর্তন কেবল আনা যেতে পারে আগামী সংসদে। রাষ্ট্রের মূলনীতিতে হাত দেয়াটাও এখন অনুচিত বলে তারা হয়তো মনে করেন। সুশীল সমাজ থেকেও এমন মত ব্যক্ত করা হচ্ছে।
ঐকমত্য কমিশন এর মধ্যে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বসেছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর মতো তাদের মধ্যেও মতপার্থক্য থাকবে, এটা স্বাভাবিক। আবার এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে এরই মধ্যে সবাই একমত। এসব নিয়ে আলোচনারও কিছু নেই। সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট থেকে এমন বেশ কিছু সুপারিশ আলাদা করেছিল সরকার। কিন্তু সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ, এগুলোর বাস্তবায়নে এখনো জোরালো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কেন হয়নি, তার কারণও অজানা। প্রথম দফা সংলাপে যেসব সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য মিলেছিল, সেগুলোর বাস্তবায়নও শুরু করে দেয়া যেত। জুলাই সনদে সব বিষয়কে একত্রে স্থান দিয়ে তারপর সেগুলোর বাস্তবায়ন শুরু করা হলে যথেষ্ট সময় মিলবে না বলেও অনেকে মনে করেন। এরই মধ্যে কিছু আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে গিয়ে সরকারের বিপাকে পড়ার বিষয়টিও লক্ষণীয়। সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নের কাজ তো সহজ নয়।
একথা অবশ্য ঠিক, সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়ে থাকলে নির্বাচিত সরকারও সেটা বাস্তবায়ন করতে পারবে। নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকারই গঠিত হোক, রাষ্ট্র সংস্কার তার একটি বড় করণীয় হবে। পরিস্থিতি শেষতক এমনও দাঁড়াতে পারে, নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার সেরেই দ্রুত নির্বাচনের দিকে যেতে হতে পারে সরকারকে। গণ-অভ্যুত্থানের পর দীর্ঘ সময় ধরে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকলে কিছু ‘অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন’ও অনেক ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা যায়। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে বিপন্ন হতে দেখা যায় জান-মালের নিরাপত্তা। বাংলাদেশেও সেটা চলমান বললে ভুল হবে না। এর বড় প্রমাণ অব্যাহত মব ভায়োলেন্স। নজিরবিহীনভাবে ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনীকে সক্রিয় করা যায়নি আজও। এদিকে সেনারা যত দ্রুত সম্ভব ফিরে যেতে চাইছে ব্যারাকে। অস্থির এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতিও স্থবিরতার শিকার। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগে অগ্রগতি নেই। এ অবস্থায় সংস্কারের জন্য দীর্ঘ সময় নেওয়াটা মঙ্গলজনক নাও হতে পারে বলে মত রয়েছে।
এসব বলার অর্থ এটা নয় যে, সুযোগ থাকলেও ঐকমত্যের ক্ষেত্রগুলোয় সংস্কারে যাওয়ার দরকার নেই। এমনটা কেউ বলছেন না। প্রায় এগারো মাসে সরকার কোন কোন ক্ষেত্রে কী পরিবর্তন এনেছে, সে প্রশ্ন বরং উত্থাপন করছেন অনেকে। অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন কেন গঠিত হলো না, সে প্রশ্নও তোলা হচ্ছে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট কেন অসম্পূর্ণ- এ প্রশ্নও উঠেছে বৈকি। জুলাই আন্দোলনের মধ্যভাগেও রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন সামনে আসেনি তো কী হয়েছে! হাসিনা সরকারের পতন পরবর্তী পরিস্থিতি সংস্কারের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আর সেটা যথাসম্ভব গ্রহণ করতে চাইছে সবাই। তবে শর্ত হলো, এর অনুকূল পরিবেশ থাকতে হবে।
জুলাই সনদ ঘোষণার সঙ্গে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিচার করে সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নের রোডম্যাপও নিশ্চয় চূড়ান্ত করা যাবে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলেও পাক্কা সাত মাস হাতে থাকবে। এ অবস্থায় রুটিন কাজের পাশাপাশি সরকার সব পক্ষের কাছে ‘জরুরি’ বলে বিবেচিত সংস্কারগুলোও যদি করতে পারে, সেটা কম অগ্রগতি হবে না। সবশেষে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে না পারলে অবশ্য সব কিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। সে লক্ষ্যে অটল থেকে যতটা সম্ভব সংস্কারে মনোনিবেশ করাটাই হবে সামনের দিনগুলোয় সরকারের করণীয়।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক