হ ত ভা গা র চি ঠি ২২

ছিল সরকার নবায়ন করার নির্বাচন

শামীমুল হক | মতামত
জুন ২১, ২০২৫
ছিল সরকার নবায়ন করার নির্বাচন

প্রিয় হাসু আপা, নিশ্চয় উৎফুল্ল আপনি। গত সপ্তাহ জুড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাউর হয়েছে- আপনি দেশ থেকে পালানোর আগে আপনার স্বজনদের একটি মেসেজ পাঠিয়েছেন। ৩রা আগস্ট পাঠানো ওই মেসেজে তাদের দেশ ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। আপনি যখন এ নির্দেশ দেন তখন আপনার ভাইপো তাপস তখন ছিলেন সিঙ্গাপুরে। ৩রা আগস্ট বিমানবন্দরে নেমে যখন তিনি এ নির্দেশের কথা শুনেন সঙ্গে সঙ্গে পরের ফ্লাইটে ফের সিঙ্গাপুর চলে যান। আপা আপনি মহান। আপনি মহৎ। তাই তো আপনি আপনার স্বজনদের মেসেজে বার্তা পাঠালেও কোনো নেতাকর্মীকে ঘুর্ণাক্ষরেও জানতে দেননি এ কথা। এরপর ৫ই আগস্ট আপনি দেশ থেকে পালিয়ে যান। জানি না হাছা না মিছা। আপনার নামে এমন তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখে দেশের মানুষ বলাবলি করছে হাসিনার কাছে তো এটাই স্বাভাবিক। এসব শুনে খুবই কষ্ট পাই। তখনই একটা গান খুব মনে পড়ে- ভাইঙ্গা দিয়া আমার অন্তর/কার বুকে বান্দিয়া ঘর/ ভালোবাসার করলিরে দাফন/একটুওরে তোর নাইরে মায়া/পাষাণে বান্দিয়া হিয়া/ বুঝাইলি তোর নিষ্ঠুর আচরণ/আমায় কইরা গেলি পর/তুই বাঁধলি নতুন ঘর/পর মানুষের হইলিরে আপন...। 


হাসু আপা, আপনার ভক্ত আশেকানদের মুখে এখন এ সুর। সত্যিই শুনতে খুব খারাপ লাগে। কেউ কেউ দেখছি- আপনার কাজে লজ্জিত হয়ে অন্যদলের সঙ্গে মিশে গেছে। তারা তওবা করছে জীবনে আর আপনাকে ভালোবাসা দেবে না। আচ্ছা আপা, আপনার আমলের শেষ তিনটি নির্বাচনে কতো পার্সেন্ট লোক ভোট দিয়েছিল চোখ বুঝে বলুন তো দেখি। পারছেন না? আসলে না পারার কথাই। কারণ ২০১৪ সালের নির্বাচনে কেন্দ্রগুলো ছিল ফাঁকা। মানে ভোটারশূন্য। আপনার লালিত কোনো কোনো সাংবাদিক রিপোর্টও করেছে কেন্দ্রে কুকুর ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। আর ২০১৮ সালের নির্বাচন পৃথিবীর সেরা নির্বাচন উপহার দিয়েছেন। আগের রাতে বাক্স ভরে গেছে ব্যালটে। পরদিন সেই ব্যালট গুনে সরকারকে নবায়ন করেছেন। তাও আবার ৩০ থেকে ৩৫ পার্সেন্টের বেশি ভোট দেখাতে পারেননি। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনে আমি, তুমি আর ডামির নির্বাচনে সরকার গঠন করেছেন। আপনার এমন বুদ্ধিমত্তা দেখে দেশের মানুষ লজ্জিত হয়েছে। বিদেশিরা উপহাস করেছে। তারপরও আপনি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। বুক উঁচু করে বলেছেন- জনগণ আমাদের ভোট দিয়েছে বলেই আমরা বারবার ক্ষমতায় আসছি। আপনার টার্গেট ২০৪১ ছিল। তারপর সুর ২১০০ সাল পর্যন্ত উঠেছিল। কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল। নতুন নতুন পোলাপান কোটাবিরোধী স্লোগান নিয়ে রাস্তায় নামলো। দিনের পর দিন রাস্তা অবরোধ করে রাখলো। কিন্তু সরকার প্রধান হয়েও আপনি তাদের কোনো সান্ত্বনা দিলেন না। বরং রাজাকার তকমা দিলেন। আর এতে ক্ষেপে যায় তারা। আর আপনি আপনার পুলিশ বাহিনীকে কড়া নির্দেশ দিলেন আন্দোলন থামাতে। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনাকে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে শুনেছি। অর্থাৎ আন্দোলনের সময়ের কথোপকথন এখন প্রকাশ হয়েছে। যেখানে পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, আন্দোলন দমাতে হবে। যেভাবেই হোক দমাতে হবে। আপনি নির্দেশ দেন। গুলি করতে হবে। উত্তরে আপনি বলছেন- আমি নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি। বাহ্‌ আপা বাহ্‌। আপনাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। আপনার দেশের জনগণের ওপর গুলি করার নির্দেশ আপনি দিয়ে দিলেন? একটুও চিন্তা করলেন না। আসলে আপনি ভেবেছিলেন বিএনপি, জামায়াতকে যেভাবে ঠেঙ্গিয়েছেন। নুরকে যেভাবে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে আন্দোলন দমন করেছেন। জুলাইয়ের আন্দোলনও সেভাবে দমন করে ফেলবেন। আপনার পুলিশ বাহিনী যখন গুলি করতে করতে ক্লান্ত তখন অন্য বাহিনীকে নামিয়েছেন। তারাও একই কাজ করেছে। কিছুক্ষণ আগে আপনার আরেকটি অডিও রেকর্ড শুনলাম। যেখানে আপনি বলছেন ইউনূস বাহিনী একের পর এক হত্যা করেছে। থানা পুড়িয়েছে। সরকারি দপ্তর পুড়িয়েছে। আপা আপনার মুখে এসব কথা শুনে খুবই ভালো লাগে। কারণ আপনি বিরোধী দলে থাকাকালে বোমা হামলা বা কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা সরকারের ঘাড়ে সুন্দর করে চাপিয়ে দিতেন। আর সরকারে থাকলেও আপনি তা বিরোধীদের কাঁধে চাপাতেন। আপনার এ নীতি বড্ড ফল দিয়েছিল। আপনি পালাবার আগেও মেট্রোরেলের গ্লাস ভাঙচুর দেখে যেভাবে চোখ দিয়ে পানি ফেলেছেন তা দেখে মানুষ ঘৃণা জানিয়েছে। অথচ আপনার পুলিশ বাহিনীর গুলিতে একের পর এক জনতা মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে তার জন্য কোনো আফসোস পর্যন্ত নেই। এখনো আপনি পুলিশ বাহিনীর খুনি সদস্যদের পক্ষে কথা বলছেন। আর মানুষ আপনাকে ধিক্কার দিচ্ছে। 


আপাগো, আপা- কথায় কথায় আপনি এবং আপনার দলের লোকজন এখনো বলছে দেশের চল্লিশ ভাগ লোক নৌকার। এ কথা বলার সময় একটুও কী ভাবেন গত তিনটি নির্বাচনে ৫ ভাগ লোকও কেন্দ্রে যায়নি। তাহলে বলুন এ মুহূর্তে আপনার দলের পক্ষে দেশের কতো ভাগ লোক থাকতে পারে? এক থেকে দুই পার্সেন্ট। আগের হিসাব নিয়ে স্বপ্ন দেখলে হবে? তাতে আখেরে আপনারই ক্ষতি হবে। বরং এই এক বা দুই পার্সেন্ট লোককে নিয়ে কীভাবে এগিয়ে যাবেন তা ভাবুন। দেখবেন সফলতা আসলেও আসতে পারে। আর বিদেশে বসে দেশের বিরুদ্ধে যেসব কূটচাল করছেন তার জন্য অনুতাপ তো নেই-ই বরং দেশে ফিরে এ দেশটাকে বারোটা বাজাবেন- এমন হুমকির সুর আপনার মুখে। যতই রাগ থাকুক এ রাগ নিজের মনে পুষে রাখুন। ভাবুন নিষ্ঠুরতম স্বৈরাচারী না হলে আজ আপনি কোথায় থাকতেন। হয়তো তিনটি নির্বাচনে একবার হারতেন। তাতে কী পরের বার তো ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারতেন। এখন এ স্বপ্ন কি এখনো দেখেন? যদি দেখেন তা আপাতত গোলায় তুলে রাখুন। অন্য কিছু ভাবুন। বর্তমান সরকার, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদসহ সকল দল এখন এক। তারা সবাই সংস্কার ও নির্বাচন চায়। সংস্কার যেহেতু চলমান প্রক্রিয়া তা চলমান থাকবে। এরই মধ্যে নির্বাচনও হবে। কিন্তু কি বোকারে ভাই আপনারা। যেখানে আপনার দলের লোকজন সব গুহায় লুকিয়েছে। আপনি পালিয়েছেন ভিন দেশে। সেখানে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করবে কোথা থেকে? কিংবা কীভাবে? অন্যদিকে এনসিপি যে একেবারে শিশু সেটা বুঝা গেল আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের দাবি তুলে। আরে ভাই নিষিদ্ধ করতে হবে কেন? ওরা তো এমনিতেই দৃশ্যপটে নেই। আর সরকার করলো কি এনসিপি’র দাবি মেনে কিছুটা কাটছাঁট করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। এসবের কি কোনো দরকার ছিল? এ নির্বাচন কেন, পরের নির্বাচনেও আপনার দলের ক’জন নেতা অংশ নিতে পারবে। কারণ আপনি পালিয়ে যাওয়ার পর আপনার সভা-পরিষদের অনেক দাপুটে নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ নেতাও পলাতক। কেউ কেউ দেশের বাইরে মোজ মস্তি করছে। কেউ আবার দেশের ভেতরে লুকিয়ে ছাপিয়ে আছে। অনেকে আছেন কারাগারে। আপনি তো গেলেন পালিয়ে। দলটাকে একেবারে বিধ্বস্ত করে গেলেন? আসলে ক্ষমতার লোভ বুঝি এমনই হয়। ক্ষমতা বুঝি মানুষকে অন্ধ করে দেয়? আপনার অবস্থা দেখে এমনটাই আবারো প্রমাণিত হলো। তবে একটি কথা বলি আপা? যদি মনে করেন ভালো তাহলে ভালো। আর খারাপ মনে করলে খারাপ। এই যে আপনি ক’দিন পরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাষণ দেন, দলীয় নেতাকর্মীদের উস্কে দেন, সরকারের খিস্তি খেউর করেন। বিএনপি, জামায়াতকে ধোলাই করেন। জুলাই আন্দোলনকারীদের জঙ্গি আখ্যা দিয়ে বক্তব্য রাখেন। এসব কি এই মুহূর্তে দরকার আছে। জানি ক্ষমতার মায়া ত্যাগ করতে পারছেন না। কিন্তু বাস্তবতাকে তো মানতে হবে। তাই বলছি- নিজেকে সংযত রেখে বক্তব্য দিন। দলের নেতাকর্মীদের জনগণের কাছে যেতে বলুন। নিজেদের ভুলের জন্য অনুতাপ করতে বলুন। ক্ষমা চাইতে বলুন। দেখবেন বেশি সময় আওয়ামী লীগকে অপেক্ষা করতে হবে না। আবার আওয়ামী লীগ নিজের জায়গা করে নেবে। 


উপরের গানের কলি আবার একটু আওড়াই- ভাইঙ্গা দিয়া আমার অন্তর/কার বুকে বান্দিয়া ঘর/ ভালোবাসার করলিরে দাফন/একটুওরে তোর নাইরে মায়া/ পাষাণে বান্দিয়া হিয়া/ বুঝাইলি তোর নিষ্ঠুর আচরণ/আমায় কইরা গেলি পর/তুই বাঁধলি নতুন ঘর/পর মানুষের হইলিরে আপন...। এ গানটি হয়তো আওয়ামী লীগের উপকারে আসতে পারে। তাই আবারো আওড়ালাম। ভালো থাকুন আপা। আপনি ভালো থাকলে আপনার কর্মীরাও ভালো থাকবে। 

মতামত'র অন্যান্য খবর