শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনকালে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধী দলের ওপর যে দমনপীড়ন ও গুম-খুন হয়েছে, তার নজির নিকট ইতিহাসে কম আছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুম করা, মাদক ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে শত শত মানুষকে (যার মধ্যে নিজ দলের নেতা-কর্মীরাও বাদ যাননি) হত্যা করা হয়েছে। গত বছর জুলাই আগস্টের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানকালে শিশু-তরুণসহ ১৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার সদস্য, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পদাধিকারীরা কোনোভাবে এর দায় এড়াতে পারেন না।
আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের বিচার হবে ৫ই আগস্টের আগে সংঘটিত অপরাধের জন্য। ৫ই আগস্টের পর তারা মাঠ ও দেশছাড়া। মাঝে মধ্যে দু-একটা স্থানে ঝটিকা মিছিল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী লীগের নির্বাসিত নেতা-নেত্রীর উস্কানিমূলক বক্তব্যে সরকারের ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।
ছাত্র তরুণেরা যখন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ তিন দফা দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছিলেন, তখন সরকারের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পরদিন রাতে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের বিচারকাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গত ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যে বিধিমালা সংশোধন করা হয়, তাতে দলের শাস্তির বিধান ছিল না। শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় এটি যুক্ত করা হয়। রোববার সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত ব্যক্তি বা সত্তার (সংগঠন) যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিধান যুক্ত করে সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। অধ্যাদেশে বলা হয়, সত্তার যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা যাবে। এ ছাড়া সত্তা বা তার পক্ষে বা সমর্থনে যেকোনো প্রেস বিবৃতির প্রকাশনা বা মুদ্রণ কিংবা গণমাধ্যম, অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে যেকোনো ধরনের প্রচারণা, অথবা মিছিল, সভা-সমাবেশ বা সংবাদ সম্মেলন আয়োজন বা জনসম্মুখে বক্তৃতা দেয়া নিষিদ্ধ করা যাবে। এটাকে বলা যায়, আগাম ঘোষণা। আইনে আদালতে দলকে শাস্তি দেয়ার বিধান যুক্ত করা হলেও আদালত কী শাস্তি দেবে, সেটা আগে থেকে বলার সুযোগ নেই।
আওয়ামী লীগ সরকার অন্তিম মুহূর্তে একই আইনে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছিল এবং তখন বিএনপিসহ অনেক দল এর বিরোধিতা করেছিল। আদালতের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত আসা আর নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা এক নয়। সংবিধানের সর্বোচ্চ রক্ষক আদালত।
৫ই আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে রয়েছেন। অনেক নেতা বিদেশে পালিয়ে গেছেন। অনেকে জেলে আছেন। অনেক স্থানে আওয়ামী লীগ অফিসের সাইনবোর্ড খুলে অন্য দলের সাইন বোর্ড লাগানো হচ্ছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম বন্ধে আইন সংশোধন করতে হলো কেন?
এখানে যুক্তি আসতে পারে যে, বিদেশে থেকে আওয়ামী লীগ নেতারা সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তারা ঝটিকা মিছিলও করছেন। তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা বা অপরাধবোধ দেখা যাচ্ছে না। এটা অবশ্যই নিন্দনীয়। কেউ কেউ পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন, আওয়ামী লীগ নেতারা যদি বাস্তবতা না মেনে নেন, তাদের মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র অনুশোচনা না জাগে, তাহলে জনগণের কাছে এমনিতেই ‘নিষিদ্ধ’ হয়ে যাবেন।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা বা এর কার্যক্রম বন্ধ করার পক্ষে যুক্তি হিসেবে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনের কথা বলা হয়েছে। সেই তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক, সেটা সবারই দাবি।
তবে এটা মনে রাখা জরুরি যে, দেশে আওয়ামী লীগের যে লাখ লাখ কর্মী সমর্থক আছেন, তাদের সবাই হত্যার সঙ্গে জড়িত নন, সবাই দুর্নীতি, অর্থ পাচারের সঙ্গেও জড়িত নন। তারা কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন সেটাও ভাবনার বিষয়।
তা ছাড়া জাতিসংঘের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা থেকে বিরত থাকার সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হলে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফেরার পথ রুদ্ধ হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক ভোটারকে ভোটাধিকার চর্চা থেকে বঞ্চিত করা হবে। এখন জাতিসংঘের প্রতিবেদনের একাংশকে সাক্ষ্য মেনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হলে সেটা আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় কিংবা দেশের জনগণের একটি অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কিনা, তাও মাথায় রাখতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেছেন, বিটিআরসি’র মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ইউটিউব, ফেসবুক ব্লক করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফরমগুলোকে চিঠি দেয়া হবে। সরকার বিটিআরসি’র মাধ্যমে ওয়েবসাইট বন্ধ করবে। কিন্তু একই মাধ্যম ব্যবহার করে বিদেশে থেকে আরও যারা দেশ, সরকারের নীতিনির্ধারক, রাজনৈতিক দলের নেতা ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অবিরত বিষোদ্?গার করে চলেছেন, তাদের বিষয়ে কী করবেন, সেটাও ভাবতে হবে।
দেশের ভেতরেও বিষোদ্?গার করার এই প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠেছে। সমপ্রতি তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের একটি ফেসবুক বার্তাকে কেন্দ্র করে কীভাবে তাকে হেনস্তা করা হয়েছে, সেটা সবার জানা। তিনি একাত্তরের গণহত্যার সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে বলেছিলেন মাত্র। একই সঙ্গে তিনি আওয়ামী বামদেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন। আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ করার দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে জাতীয় সংগীত পরিবেশনেও একপক্ষ বাধা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার দাবির সঙ্গে এসব মেলালে শঙ্কিত হতে হয় বৈকি।
আমরা যদি আওয়ামী লীগের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই (যা জুলাই অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল), যদি গণতান্ত্রিক ধারা ও প্রক্রিয়ায় সমাজের সব অংশের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে ‘দল নিষিদ্ধ’ কোনো সমাধান নয়। অপরাধের বিচার আর ‘দল নিষিদ্ধ’ করার বিষয়টি এক পাল্লায় মাপা যাবে না। যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, তাদের উপযুক্ত শাস্তি হোক, কিন্তু আওয়ামী লীগ করছেন বলে সমাজের একাংশকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয়া কতোটা সমীচীন হবে সেই প্রশ্ন উঠবে।
বাংলাদেশে নিকট ও সুদূর ইতিহাসে অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঔপনিবেশিক বৃটিশ সরকার ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করেছিল। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট পার্টি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীও নিষিদ্ধ ছিল। পঁচাত্তর সালে দেশের সব দল নিষিদ্ধ করে একটি দল বাকশাল গঠন করা হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে কমিউনিস্ট পার্টি ও ডেমোক্রেটিক লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এদের মধ্যে জনগণ যাদের গ্রহণ করেছে, তারা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। যারা জনগণ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, তারা হারিয়ে গেছে। অতএব, রাষ্ট্রের মালিক জনগণের হাতেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার ছেড়ে দেয়া উচিত। তাৎক্ষণিক সুবিধা পেতে দেশ ও রাজনীতির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি আওয়ামী লীগ সরকার করেছে। সেই ক্ষতি বোধ হয় আর বাড়তে দেয়া ঠিক হবে না।