অন্তর্বর্তী সরকারের ‘১৮ মাসের মধ্যে’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা এক বিদেশি সংবাদ মাধ্যমকে অনেক আগেই বলেছিলেন সেনাপ্রধান। স্থানীয় নয়; জাতীয় নির্বাচনের কথাই তিনি বলেছিলেন। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তার ভেতর দিয়ে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার আসবে দেশে। স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের ফলে যে নজিরবিহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেখান থেকে স্বাভাবিকতায় ফেরার এটাই সবচাইতে গ্রহণযোগ্য পথ। সেনাপ্রধান বলেছিলেন, ১৮ মাসের মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচন আয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকবে সরকার। ২০২৪ সালের ৮ই আগস্ট শপথ নিয়েছিল মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সে হিসেবে আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হলেও সেনাপ্রধানের কথা রাখা হয়।
সেনাপ্রধান নিশ্চয়ই সেনাবাহিনীর মনোভাবই ব্যক্ত করেছিলেন। ইউনূস সরকার যে এর সঙ্গে খুব ভিন্নমত ছিল, তাও নয়। ড. ইউনূস জাতিকে জানিয়েছিলেন, নির্বাচনের সময়টা নির্ভর করছে সংস্কারের ওপর। ‘কম সংস্কার’ হলে ডিসেম্বর আর ‘বেশি সংস্কার’ হলে আগামী বছরের জুনের মধ্যেই নির্বাচন। এ অবস্থায় মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। সেগুলোর সুপারিশও এসে গেছে সরকারের হাতে। বাছাইকৃত শতাধিক সুপারিশ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর। এর মধ্যে নানান উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা কিন্তু একাধিকবার বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করা হবে। নবগঠিত ইসিও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ধরে নিয়েই কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এর মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসিও নিবন্ধন বাতিল করেছে দলটির। সরকার আইসিটি আইনে পরিবর্তন এনে অভিযুক্ত দলের বিচারের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের বিচার সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত দলটি কোনো কার্যক্রম চালাতে পারবে না। রাজনৈতিক দলগুলো যার যার অবস্থান থেকে এ সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানিয়েছে। তবে বিতর্ক দানা বেঁধে ওঠে মিয়ানমারের রাখাইনে ‘মানবিক করিডোর’ দেয়ার প্রস্তাব ঘিরে। চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার কাজ বিদেশি কোম্পানিকে দেয়ার ব্যাপারে সরকারের উৎসাহ নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বলা হচ্ছিল, সরকার এসব ‘স্পর্শকাতর বিষয়ে’ স্বচ্ছতার পরিচয় দিচ্ছে না। এ প্রশ্নও ওঠে, অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে কিনা।
এরই মধ্যে বাজারে কানাঘুষা চলছিল সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি নিয়ে। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জল্পনা অব্যাহত ছিল। এ অবস্থায় সেনাপ্রধানসহ তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে বৈঠক হয় ড. ইউনূস ও তার ক’জন সহকর্মীর। সে বৈঠকের পর হালে নিয়োগ পাওয়া নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে এসে নিজ নাগরিকত্ব বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য রাখলেও মানবিক করিডোর ইস্যুতে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেননি। এর পাশাপাশি ঘটে আরেকটি বড় ঘটনা। সেনাপ্রধান তার সহযোগী কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে বসে মানবিক করিডোরসহ বিভিন্ন ইস্যুতে জোরালো বক্তব্য রাখেন। গণতন্ত্রে উত্তরণে দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়ার ওপর তিনি সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন সেখানে। আগের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হয়ে যাওয়া উচিত। চলমান সংস্কার আলোচনা নিয়ে বলেন, এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে তার কোনো কথাবার্তা হয়নি। কোনো ধরনের সংস্কার না করে নির্বাচনে চলে যাওয়ার কথা কিন্তু তিনি বলেননি। কার্যত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার কিংবা এর বিরোধিতা কেউই করছে না।
সেনাপ্রধানের এসব বক্তব্যের সঙ্গে অন্য সামরিক কর্মকর্তারা একমত বলেই মনে হয়। সংবাদ মাধ্যমে অন্তত কোনো ভিন্নমতের কথা জানা যায়নি। বড় ধরনের ভিন্নমত থাকলে সেনাপ্রধান এত জোরালোভাবে বক্তব্য রাখতেন বলেও মনে হয় না। মানবিক করিডোর, এমনকি চট্টগ্রাম বন্দর সংক্রান্ত সিদ্ধান্তও নির্বাচিত সরকারের নেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। তার বক্তব্যে এমনটিও এসেছে- রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে অনুচিত। একই মনোভাব কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো থেকেও ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে সরকার ক্রমে এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে ঝুঁকছে বললে ভুল হবে না। ধারণা করা যায়, সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর তাদের মনোভাব বদলাবে। সরকারের মধ্যে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতাও বাড়ছে। এর প্রমাণ- গভীর রাতে এনবিআর ভেঙে একে দুই টুকরো করার প্রজ্ঞাপন জারির ঘটনা। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের শর্ত পূরণে এটি করতে গিয়ে খোদ এনবিআর কর্মীদের তীব্র বাধার মুখে পিছিয়েও এসেছে সরকার। সংস্থাটিতে আপাতত আগের নিয়মেই কাজ চলবে। আইএমএফের ঋণের কিস্তি নিয়েও বড় জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল মূলত সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায়। সামনেই বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থ উপদেষ্টা। বাজেট নিয়ে কিন্তু এর স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি এবার।
লক্ষণীয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সেনাপ্রধান তেমন কিছু বলেননি। অর্থনীতি, বিশেষত আর্থিক খাতকে সংকটমুক্ত করার কাজে সরকার খারাপ করছে না। নতুন গভর্নর তৎপর রয়েছেন। তবে সরকার অর্থনীতি বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়নে যে কমিটি গঠন করেছিল, তার প্রধান অর্থনীতি পুনর্গঠন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে চলেছেন। শিক্ষা কমিশন হয়নি বলেও অনেকে হতাশ। তবে বেশি হতাশা সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষাঙ্গন ঘিরে। শিক্ষাঙ্গন থেকে গণ-অভ্যুত্থানের সূত্রপাত হয়েছিল এবং ছাত্র-তরুণরাই এতে নেতৃত্ব দেন, এটা অনস্বীকার্য। এও বলতে হবে, শিক্ষাঙ্গন দীর্ঘ নয় মাস পরও স্বাভাবিকতায় ফেরেনি। মব ভায়োলেন্স চলছে সেখানেও। মব সামলাতে না পেরেই ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়তে হয়। এর পরও শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা উঠে আসছে রাজপথে। অন্যান্য দাবিতেও ‘যমুনা’ অভিমুখে মিছিল, সড়ক অবরোধ হচ্ছে। এটা যেন দাবি মানার সরকার। অন্যায্য দাবিও মানতে হবে! এদিকে শুরু থেকে চলছে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ খুঁজে বের করে তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি দেয়ার প্রবণতা। এটা বন্ধে সরকারকে উদ্যোগী দেখতে না পেয়েই সেনাপ্রধান বলেছেন, সেনাবাহিনী আর মব সহ্য করবে না। তবে আগের মতো এ মনোভাবও ব্যক্ত করেছেন যে, দ্রুতই তারা ব্যারাকে ফিরতে চান। সেনাবাহিনীকে দিয়ে দীর্ঘদিন পুলিশি দায়িত্ব পালন করানোর ব্যাপারে তাদের আপত্তি থাকাই স্বাভাবিক। সরকার নয় মাসেও পুলিশকে পুরো সক্রিয় করতে পারেনি। বিতর্কিত পুলিশের পোশাক পরিবর্তনেও সক্ষম হয়নি সরকার।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাঠে নামলেও গণ-অভ্যুত্থানের শুরু থেকে সেনাবাহিনী হাসিনা সরকারকে তেমন সহযোগিতা করেনি। এতে সর্বস্তরের মানুষের ব্যাপক সম্পৃক্ততা দেখে তারা ৩রা আগস্টেই সিদ্ধান্ত নেন জনবিচ্ছিন্ন সরকারের আদেশ মান্য না করার। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ‘আত্মীয়’ বলে পরিচিত হলেও এমন ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হননি সেনাপ্রধান। এ অবস্থায় ৫ই আগস্ট সরকারের পতন ঘটলে তিনি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে মুখ্য ভূমিকা রাখতেও এগিয়ে আসেন। আন্দোলনে থাকা সব রাজনৈতিক দল ও পক্ষের সঙ্গে আলাপ করে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠনে ভূমিকা রাখেন তিনি। এর আগে চলমান আন্দোলনের ভেতর থেকে সেনাশাসন জারির আহ্বান কিন্তু উঠেছিল। তেমন কিছু ঘটলে সে পরিস্থিতিতে তাদের বড় বাধার সম্মুখীন হতে হতো বলেও মনে হয় না। কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্যে এমন কোনো মনোভাব দেখতে পায়নি কেউ। আন্দোলনে রক্তক্ষয় কমাতে এবং রাজনৈতিক উত্তরণে ভূমিকা রাখতেই বরং আগ্রহী দেখা গেছে তাদের। তারপরও সেনাপ্রধানের তৎকালীন ভূমিকা নিয়ে নেতিবাচক আলাপ তুলতে দেখা গিয়েছে একটি মহলকে। তার পরবর্তী ভূমিকা, উদ্দেশ্য ইত্যাদি নিয়ে তথ্য-প্রমাণহীন অভিযোগ ছড়াতেও তৎপর দেখা গেছে তাদের। কিন্তু সেনাপ্রধানের সর্বশেষ যে অবস্থান সামনে এলো, সেটা বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে দেশকে উত্তরণের দিকে নিয়ে যেতে সহায়ক বলেই মনে হয়। তার পূর্বাপর অবস্থানে ধারাবাহিকতাও পরিলক্ষিত।
মাঝে দেশের একটি বড় সংবাদপত্রকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সেনাবাহিনী রাজনীতিতে জড়াতে চায় না। দেশ পরিচালনার কাজ তাদের নয়। অন্তর্বর্তী সরকারকে যেকোনো মূল্যে সহায়তা করে যেতে সেনাবাহিনী প্রস্তুত। তবে তারা যত দ্রুত সম্ভব ব্যারাকে ফিরতে ইচ্ছুক। এজন্যও সেনাবাহিনী দ্রুত নির্বাচন চাইছে- এটাই সেনাপ্রধানের অভিমত।
রাজনৈতিক অঙ্গনেও দ্রুত নির্বাচনের দাবি ক্রমে জোরালো হয়ে উঠেছে। এর বিরুদ্ধে কোনো পক্ষ নেই, তা অবশ্য নয়। সরকারের ভেতরেও তারা শক্তিশালী বলে অনেকদিন ধরে কথাবার্তা হচ্ছে। ড. ইউনূস তাদের ‘প্রভাব বলয়ে’ আছেন বলেও মনে করা হয়। মাঝে তিনি নতুন একটি রাজনৈতিক দল নিয়ে অনুরাগ ব্যক্ত করে বক্তব্য রাখেন। এতে তার নিরপেক্ষতা খর্ব হচ্ছে বলে সমালোচনা ওঠে এ মুহূর্তে দেশের প্রধান দল বিএনপি’র তরফ থেকে। দলটি মনে করে, তাদের ক্ষমতায় আসার সুযোগ কেড়ে নিতেই নির্বাচন বিষয়ে স্পষ্ট রোডম্যাপ দিচ্ছে না সরকার। এ অবস্থায় সেনাপ্রধান ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চেয়ে বিএনপি’র সঙ্গে সুর মেলালেন বলে মন্তব্যের সুযোগ অবশ্য নেই। এটা তার স্বতন্ত্র অবস্থান। ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন করে গণতন্ত্রে উত্তরণের দিকে যাওয়ার কথা তিনি বলেছেন এসব জটিলতা সৃষ্টিরও আগে। প্রধান উপদেষ্টা অবশ্য তখন বলেছিলেন, এটি সেনাপ্রধানের মত। নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করবে সরকার। ‘ডিসেম্বরের মধ্যে’ নির্বাচন দিতে সরকার অনিচ্ছুক, এটা কিন্তু ড. ইউনূস বলেননি কখনো। বরং এ সম্ভাবনার কথাই বেশি করে বলেছেন। নভেম্বর-ডিসেম্বরে আবহাওয়াও নির্বাচনের অনুকূলে থাকবে। দেখা যাক, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কী করেন। নজিরবিহীন সংকট থেকে জাতিকে উত্তরণের দিকে নেয়ার যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, সেখান থেকে পিছপা হওয়ার সুযোগ কি তার রয়েছে?
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক