হ ত ভা গা র চি ঠি ২১

আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর

শামীমুল হক | মতামত
মে ২৪, ২০২৫
আল্লাহর মাইর  দুনিয়ার বাইর

শ্রদ্ধেয়, হাসু আপা। প্রথমেই আমার সালাম নিবেন। জানি রাজা থেকে একেবারে অন্য দেশের আশ্রিতা হয়ে আপনি ভালো নেই। তারপরও ভদ্রতার খাতিরে বলতে হয়, কেমন আছেন আপনি? এর উত্তরেরও আশা করছি না। কারণ আপনি মহাজ্ঞানী। আপনার জ্ঞানের ভাণ্ডারের যত ক্যারিশমা বাংলাদেশকে দেখিয়ে গেছেন তা ইতিহাস হয়ে রইবে। পৃথিবী যতদিন থাকবে আপনার ইতিহাস ততদিন থাকবে। এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। আমরা যখন শত বছর পর এসে মোঘল সম্রাট আর নবাবদের নিয়ে ইতিহাস চর্চা করি ঠিক আপনাকে নিয়েও এমন চর্চা হবে। হিটলারের কথা কিন্তু মানুষ এখনো উদাহরণ হিসেবে টানে। সে যাকগে আপা, ওসব কথা বলে এখন আর লাভ নেই। বাংলাদেশের বেশির ভাগ পুলাপাইন বড্ড আজাইরা। ওরা সারাদিন শুধু ফেসবুক আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কতো কিছু যে বানায় আপনারে লইয়া? এসব নিয়ে লাখ লাখ ভিউ হয়। এতে বুঝা যায় আপনাকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ আছে। আপনি দেশ থেকে পালানোর পর ওরা আপনার বক্তব্যের চুম্বক অংশ কেটে তা ফেসবুকে ছেড়ে দিচ্ছে। যেখানে শুধু বিরোধী দলের উদ্দেশ্যে খিস্তিখেউর। আবার ওইদিন দেখলাম সংসদে দাঁড়িয়ে আপনি বলছেন, বাংলাদেশে এমন কোনো শক্তির পয়দা হয় নাই যে, আওয়ামী লীগকে দেশ ছাড়া করবে। আওয়ামী লীগ কখনো পালায় না। আওয়ামী লীগ পালাবে না। কিন্তু আপনার একটি বক্তব্যের জেরেই পালাতে হলো আপনাকে। কোটা সংস্কার নিয়ে গত বছরের জুলাই মাসে শুরু হয় আন্দোলন। প্রথমদিকে শিক্ষার্থীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চালিয়ে আসছিলেন। মধ্য জুলাইয়ে তা সহিংসতায় রূপ নেয়। আন্দোলন দমাতে আপনার নির্দেশনায় নামানো হয় পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। চারশ’র বেশি মানুষকে বাহিনীগুলো নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনের মধ্যে ১৪ই জুলাই আপনি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে বলে বসলেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে আপনার এমন বক্তব্যে মর্মাহত ও অপমানিত বোধ করায় স্লোগানে স্লোগানে প্রতিক্রিয়া দেখান শিক্ষার্থীরা। এদিনই রাত ১০টার পর প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ভেতরে জড়ো হয়ে স্লোগান আর বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন তারা। রাত ১১টার পর থেকে ১টা পর্যন্ত বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে এসে জড়ো হন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে। কোটার বিরোধিতা নিয়ে আপনার বক্তব্যের বিরোধিতায় তারা টিএসসি ও এর আশপাশে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। মাঝেমধ্যেই স্লোগানে উচ্চকিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীরাও বিভিন্ন হল থেকে বেরিয়ে যোগ দেন মধ্যরাতের এ বিক্ষোভে। শিক্ষার্থীদের একটি অংশ মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। মিছিলে শিক্ষার্থীরা ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘তুমি নও, আমি নই, রাজাকার, রাজাকার’, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারও বাপের না’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। তাদের ক্ষোভ কোটা আন্দোলন নিয়ে আপনার বক্তব্যকে ঘিরে। তবে পরদিন সকালে ওবায়দুল কাদের এক বক্তব্যে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঔদ্ধত্যের জবাব দেবে ছাত্রলীগ’। সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়। এর প্রতিবাদে পরদিন ১৬ই জুলাই সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনে বিক্ষোভের ডাক দেয়া হয়। সেদিন রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলিতে আবু সাঈদ নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। ১৭ই জুলাই জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে আপনি শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনার বিশ্বাস শিক্ষার্থীরা আদালতে ন্যায়বিচার পাবে। 


পরের দিন কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির ডাক আসে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। সেদিন ঢাকার বাড্ডা, রামপুরা ও উত্তরায় সংঘাতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। দুপুরের পর রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা হতে থাকে। পরের তিন/চারদিন ধরে চলে সংঘর্ষ। সরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা ১৫০ জন হলেও বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৩শ’র কাছাকাছি। কারফিউ জারি করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। সরকার পতনের দাবিও সামনে আসে। আপনি সে সময় আলোচনার জন্য ডাকলেও শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরইমধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে সরকার পদত্যাগের একদফা দাবি ঘোষণা করেন। জনসমুদ্রে পরিণত হয় এ বিক্ষোভ সমাবেশ। 


‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তন করে মঙ্গলবারের পরিবর্তে সোমবার পালনের ঘোষণা দেয় তারা। এতে সারা দেশ থেকে আন্দোলনকারীদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানানো হয়। এসব ঘটনায় রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ করা হয়। এই সিদ্ধান্ত ঢাকাসহ সব বিভাগীয় সদর, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, শিল্পাঞ্চল, জেলা ও উপজেলা সদরের জন্য কার্যকর হবে বলে জানায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে কারফিউ মানেনি শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। তারা বেরিয়ে আসেন রাস্তায়। এরপর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়েন আপনিসহ আপনার পরিষদ। 


আপা, আপাগো-খুব কষ্ট হয়। আপনি কেন এমন বক্তব্য দিতে গেলেন? কেন আপনি চুপ করে থাকতে পারেন না। আপনি তো নিশ্চয় জানেন বোবার কোনো শত্রু নেই। তারপরও একের পর এক উল্টাপাল্টা বক্তব্য গত প্রায় ষোলটি বছর বলে গেছেন। কেন গো আপা? কথা না বললে কি আপনার পেটের ভাত হজম হয় না? নাকি ঘুমের ডিস্টার্ব হয়? সে যাকগে সেদিন দেখলাম আপনার এক বক্তব্যে তারেক রহমানকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন- সাহস থাকলে দেশে আয়। তারপর বুঝবি কতো ধানে কতো চাল। খালেদা জিয়াকে নিয়ে কতো নোংরা কথা বলেছেন, মনে পড়ে আপা সেগুলো। এখন তো বিস্তর সময় আপনার হাতে। একটু চোখ বুজে চিন্তা করে দেখুন তো সেসব কথা বলা কতোটুকু যৌক্তিক ছিল? পরশু দিন এমনই এক বক্তব্য ফেসবুকে ভেসে উঠলো। যেখানে খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন- আল্লাহর মাইর, দুনিয়ার বাইর। ঠিক তাই আপা। আপনি যা বলেছেন তা সবাই বলে থাকেন। এখন মানুষ আপনার এ পরিণতি দেখে তারাও বলছে- আল্লাহর মাইর, দুনিয়ার বাইর। মানুষ বলছে, ষোল বছর আপনার কাজের পুরস্কার পাচ্ছেন আপনি। আচ্ছা আপা, আমরা যারা আপনাকে ভালোবাসি। আপনাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করি তাদের কী দোষ ছিল বলুন? আপনি যাওয়ার সময় তো তাদের কথাও চিন্তা করলেন না। এখন মাঝে মাঝে আপনার ফোনালাপ ফাঁস হয়। কোনো নেতা বা কর্মীর সঙ্গে আপনার কথোপকথন শুনে মানুষ আরও ক্ষিপ্ত হয়। আর আপনি যার সঙ্গে কথা বলছেন, সে কি উদ্দেশ্যে ফোন করেছে সেটা না বুঝেই আপনি জ্বালাময়ী বক্তব্য দিতে শুরু করেন। ক্ষমতায় থাকতে আপনি যেমনভাবে জনতাকে পিষেছেন, ঠিক এখনো জনতাকে পিষানোর নির্দেশ দিচ্ছেন। আপনার এ উস্কানি দেশের কী কোনো লাভ হবে? বরং কেউ কেউ বলছেন আপনি এখন ঘষেটি বেগমের রোল প্লে করছেন।
সে যাই হোক আপা, একটা অনুরোধ করি মনে চাইলে রাইখেন। দেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে বাংলাদেশের মানুষ দিন দিন আশাহত হচ্ছে। আপনি নেতাকর্মীদের না উস্কিয়ে দেশের মানুষের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিন। বিগত দিনের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করুন। দেখবেন দিন দিন আপনি একটু একটু করে মানুষের মনে আবার জায়গা করে নিচ্ছেন। বিএনপি বা জামায়াতের বিরুদ্ধে কোনো বিষোদ্গার না করে নিজের কথা শুধু বলে যান। দলীয় নেতাকর্মীদের একটু ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। দীর্ঘ একুশ বছর পর এ দেশের মানুষ সব ভুলে আপনার দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। মনে রাখবেন জনগণ ইচ্ছা করলেই সব পারে। তারা ক্যারিশমা কিংবা মারপ্যাঁচ বুঝে না। তারা বুঝে তাদের রাজা হবে মানবদরদী। আপনিও হতে পারেন তাদের মনের মতো। কিন্তু গত ষোল বছরের খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে। তাহলেই সম্ভব। অন্যথায় ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন-এর থেকে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন। আপনার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। আজ এ পর্যন্তই। ভালো থাকবেন আজীবন। আল্লাহ হাফেজ। 

মতামত'র অন্যান্য খবর