প্রশ্নটা উঠেছিল দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে। কোন কোন ব্যক্তির দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে- সেটা মূল প্রশ্ন নয়। তার চেয়েও গুরুতর প্রশ্ন ছিল রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে এমন লোকদেরকে বসানো উচিত কি-না।
দু’একটি জায়গা-যেমন সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, বা সরকারি কর্মচারী, এসব পদ ছাড়া অন্য দায়িত্বে দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে এমন ব্যক্তিকে বসানোর ক্ষেত্রে সম্ভবত আইনগত তেমন কোনো বাধা নেই। কিন্তু নৈতিকতা বা অতীত অভিজ্ঞতা বলেও তো একটা বিষয় রয়েছে। আগের সরকারের আমলে এনিয়ে প্রচুর অনিয়ম হয়েছে, সেসব নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে। কিন্তু একটা অনিয়ম তো আর একটি অনিয়মকে বৈধতা দেয় না। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন দায়িত্ব নিলো, দেখা গেল এদের মধ্যেও সেই একই প্রবণতা। বরং বলা যায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগের যেকোনো সময়ের চেয়েও বেশি।
বেশ কিছু নাম এরই মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে। ড. খলিলুর রহমান, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, লুৎফে সিদ্দিকী, আশিক চৌধুরী, ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী, মোহাম্মদ সুফিউর রহমান, শেখ মইনউদ্দিন, ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব, আশিক চৌধুরী, ড. আলী রীয়াজ, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মোশতাক হুসেন খান, লামিয়া মোরশেদ, মনির হায়দার, মুশফিকুল ফজল আনসারী, শাজিব এম খায়রুল ইসলাম- এমন অনেককে নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। এরা কি দ্বৈত নাগরিক? এই প্রশ্নগুলো যখন ওঠেছে, তখন সরকারের কিংবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উচিত ছিল বিষয়টা পরিষ্কার করা। কিন্তু তারা তা করেননি। বরং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি, যিনি বিভিন্ন সময় সরকারের মুখপাত্রের মতো ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে থাকেন, উল্টো প্রমাণ দাবি করেছেন। বলেছেন-অভিযোগগুলো যারা করেছেন তারা কেন প্রমাণ হাজির করছেন না?
আচ্ছা মানুষ প্রশ্নগুলো করছে কেন? কেন ওই লোকগুলোর নামই উল্লেখ করছে? কারণ, এই লোকগুলো দীর্ঘ সময় টানা বিদেশে অবস্থান করেছেন। তাহলে সেখানে তারা কীভাবে, কোন স্ট্যাটাসে ছিলেন? অবৈধভাবে নিশ্চয়ই ছিলেন না। হয় সেই দেশের নাগরিকত্ব লাভ করেছেন, অথবা গ্রিনকার্ড বা পারমানেন্ট রেসিডেন্ট পেয়েছিলেন। কিছু একটা তো নিশ্চয়ই ছিল। মূল কথা হচ্ছে, সেই স্ট্যাটাসটা বললেই হয়। তাহলেই তো সব সন্দেহের অবসান হয়ে যায়। কিন্তু তারা তা বলবেন না। বিষয়টাকে তারা অন্ধকারেই রাখবেন। তাহলে কীভাবে হবে? মানুষের জানার কি অধিকার নেই? মানুষ কি প্রশ্ন করতে পারবেন না? সরকারই তো পারে এসব প্রশ্নের জবাব দিতে। কেন দিচ্ছে না? ওই লোকগুলো, যাদের সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে, তারাও কেন চুপ করে আছেন? এই নীরবতাই কি প্রকারান্তরে মানুষের সন্দেহগুলোকে আরও তীব্র করে তুলছে না?
এদের মধ্যে একজন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান অবশ্য এর মধ্যে মুখ খুলেছেন। তিনি দু’বার বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছেন। একবার বললেন- তিনি বাংলাদেশের নাগরিক। এই একটি বাক্য কিন্তু সন্দেহের অবসান ঘটায় না। কারণ যিনি দ্বৈত নাগরিক, তিনি কিন্তু একই সঙ্গে দুটি দেশের নাগরিক। কাজেই তিনি যেমন বিদেশের নাগরিক, ঠিক তেমনি একই ভাবে বাংলাদেশেরও নাগরিক। পরে অবশ্য ড. খলিল অপর একটি সংবাদ সম্মেলনে জানালেন, তিনি বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের নাগরিক নন। এই কথা বলার পরও আমি অনেককে পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত হতে দেখিনি। তারা বলেছেন, এই কথাটি তিনি প্রথমবার বলেননি কেন? তাহলে কি তিনি ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন, এই সময়ের মধ্যে সেটি সারেন্ডার করেছেন? আবার অন্য প্রশ্নও উঠছে। বলা হচ্ছে-উনি যুক্তরাষ্ট্রে আছেন আজ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে। এত দীর্ঘ সময় সেখানে উনি থাকছেন কীভাবে? পরিবারের সঙ্গে থাকলেও ওনার নিজের স্ট্যাটাসটা কী ছিল?
প্রশ্ন উঠতে পারে, কেউ দ্বৈত নাগরিক হলে সমস্যাটি কোথায়? সমস্যা আছে। সমস্যা আছে বলেই প্রশ্নগুলো উঠছে। একজন মানুষ অন্য একটা দেশের নাগরিকত্ব কখন নেয়? যখন সে মনে করে তার নিজের দেশ তার থাকার উপযুক্ত নয়, তখনই তো? এই অনুপযুক্ততা বিভিন্ন ভাবেই হতে পারে। কেউ কেউ এই প্রসঙ্গে বলতে পারেন, বিদেশে যেভাবে তার মেধা বা যোগ্যতার মূল্যায়ন করছে, সেটা তার নিজের দেশের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই তাকে বিদেশে চাকরি করতে হচ্ছে। এই যুক্তিকে আমি একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছি না। অর্থ উপার্জনের জন্য যদি কেউ বিদেশে যায়, যেতেই পারে। কিন্তু সে জন্য সেই দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে হবে কেন? অথবা যদি নাগরিকত্ব গ্রহণ করতেই হয়, তাহলে যখন সে নিজ দেশে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিতে চাইবেন তখন ভিন্ন দেশের সেই নাগরিকত্ব ছেড়ে আসতে গড়িমসি কেন করবেন? ওই নাগরিকত্ব ছেড়ে আসুন, আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
আসলে দ্বৈত নাগরিকত্বের সমস্যাটা কোথায়? আমরা এই সমস্যাগুলো আগেও বহুবার দেখেছি। বিগত সরকারের অনেকেরই দ্বৈত নাগরিকত্ব ছিল। ক্ষমতায় থাকার কারণে তারা অবাধে লুটপাট করতে পেরেছে, তার সেই লুট করা অর্থ-সম্পদ তাদের সেই দ্বিতীয় দেশটিতে পাচার করেছে। হাসিনা সরকারের সিংহভাগ মন্ত্রীই এখন পালিয়ে নিজের ওই দ্বিতীয় দেশটিতে মহানন্দে দিন গুজরান করছে। এরই মধ্যে এত বিপুল অর্থ তারা পাচার করে সেখানে নিয়ে গেছে যে, তা দিয়ে তারা কয়েক পুরুষ বিদেশের মাটিতেই আরাম আয়েশে কাটাতে পারবে। আমরা দেখেছি, যখনই কেউ ইউরোপ বা আমেরিকার মতো উন্নত কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, তারা ওই দেশটিকেই তার শেষ জীবনের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে বিবেচনা করে। তাই যতদিন পারা যায়, তারা বাংলাদেশ থেকে লুটপাট করে, লুটপাটের অর্থ বাইরে পাঠিয়ে দেয়, তারপর বিপদ দেখলে দ্রুত সটকে পড়ে। সবসময়ই এদের এক পা এখানে থাকে তো অপর পা থাকে ওখানে। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা চাই।
গত ১৫ বছর দেশের শাসন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। সে সময় সবচেয়ে ক্ষমতাধর ছিল শেখ পরিবার, শেখ হাসিনার আত্মীয় স্বজনরা। সেই আত্মীয়স্বজনদের কেউ একজনও কি ধরা পড়েছে? তারা সবাই কীভাবে নিরাপদে বিদেশে চলে যেতে পারলো? বিদেশে যেয়ে তাদের কেউ কি খুব কষ্টে আছে? আসলে তারা রাজার হালে আছে। টাকা পয়সা তো অনেক আগে থেকে পাঠানো শুরু করেছিল। শেষ পর্যায়ে এসে কেবল প্রাণটা নিয়ে উড়াল দিয়েছে। আবার যদি আমরা একেবারে শীর্ষ নেতৃত্বের, অর্থাৎ শেখ হাসিনার পরিবারের কথাই ধরি, কে ছিল না বিদেশি নাগরিক? একমাত্র শেখ হাসিনা নিজে ছাড়া আর সবাই ছিলেন। তার নিজের পুত্র-কন্যা, তার বোন, বোনের পুত্র-কন্যা, কে ছিলেন না? তিনি দেশ শাসন করেছেন, শাসনের নামে লুটপাট করেছেন। নিজের পরিবার পরিজনের পাশাপাশি অনুগত চামচাদের লুটপাটের অবাধ সুযোগ করে দিয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবশ্য প্রায়ই বলছেন, পাচার হয়ে যাওয়া সেই অর্থ তারা ফেরত আনার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেটা আসলেই সম্ভব? তাদের সেই আশাবাদ কি বাস্তবসম্মত?
বিদেশের, ধরা যাক যুক্তরাষ্ট্রের, নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে গেলে শপথবাক্য পাঠ করতে হয়। কি সেই শপথ-পড়েছেন কেউ? সেখানে কি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সমুন্নত রাখার কথা বলা হয়নি? তাহলে তেমন একজন লোককে যখন আমার দেশের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসাবেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় তিনি কোন দেশের স্বার্থের প্রতি অনুগত থাকবেন? পৃথিবীর অনেক দেশেই একারণে দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগই নেই। প্রতিবেশী দেশ ভারতেই এই সুযোগ নেই, সিঙ্গাপুরেও নেই। অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে চাও? তাহলে নিজ দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে যাও। তবে ভারত বা সিঙ্গাপুরের মতো বাস্তবতা হয়তো আমাদের দেশে নেই। কারণ এরই মধ্যে এদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে ফেলেছে। তাই আমি দ্বৈত নাগরিকত্বের বিপক্ষে নই। কেউ দ্বৈত নাগরিক হয়ে থাকলে থাকুন, কোনো সমস্যা নেই। তবে তাকে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বা নীতিনির্ধারণী কোনো পদে বসানো যাবে না। এই যে বর্তমানে সংস্কার কার্যক্রম চলছে, এর দায়িত্বে কোনো দ্বৈত নাগরিক কেন থাকবেন? বিদেশ থেকে এসে তারা আমাদের পলিসি তৈরি করে দিয়ে যাবেন? এটা হয় না।
দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে এরই মধ্যে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। আমরা মনে করি, মানুষের মনে থাকা এবং উচ্চারিত হওয়া সন্দেহগুলোর নিরসন হওয়া দরকার। একাজটা সরকারকেই করতে হবে। আর যদি এ বিষয়ে নীরব থাকার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার, তাহলে বুঝতে হবে ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।