এ ই স ম য়

প্রশ্নবিদ্ধ জাপা’র রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন পথে

পিয়াস সরকার | মতামত
মে ২৫, ২০২৫
প্রশ্নবিদ্ধ জাপা’র রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন পথে

কাওরান বাজার। দেশ-দশ নিয়ে সাধারণ মানুষের ভাবনা জানতে এই এলাকা অতুলনীয়। এখানে চায়ের কাপে ফুঁ দেন ভিন্ন শ্রেণি, অর্থনীতি, চিন্তার মানুষ। মানবজমিন অফিসের পাশেই রুবেল ভাইয়ের চায়ের দোকান। এই তো সেদিন বৃষ্টির মাঝে আটকা। তুমুল আলোচনা চলছে রাজনীতি নিয়ে। পাশেই ভাগ্য ফেরানোর জাদুমন্ত্র আংটি বিক্রি চলছে। দাম মাত্র ১০১ টাকা। আলোচনায় একটু ঘি ঢাললাম। জাতীয় পার্টির কথা বলতেই, সবার মুখে একটা মুচকি হাসি।
এই দোকানের চারপাশে আগে দেখতাম আওয়ামী লীগের পোস্টার। এখন আর সে পোস্টার নেই। তবে একটি পোস্টারে চোখ আটকে গেল। জাতীয় পার্টির অর্ধেক ছেঁড়া, ময়লা একটা পোস্টার। এসময় হঠাৎ একটা গান বেজে উঠলো। বাউল কবি রাধারমণ দত্তের অমর গান-


জলের ঘাটে দেখিয়া আইলাম, কি সুন্দর শ্যামরায়।
শ্যামরায় ভোমরা গো, ঘুরিয়া ঘুরিয়া মধু খায়।
নিত্তি নিত্তি ফুল বাগানে, ভ্রমর আসে মধু খায়
আয় গো ললিতা সখি, আবার দেখি শ্যামরায়।


৫ই আগস্ট ২০২৪। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় একটি দিন। ‘লৌহ মানবী’ শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে উড়াল দেন। এরপর কতো পরিবর্তন এলো দেশে। কিন্তু জাতীয় পার্টি? বর্তমান অবস্থানে তাকানোর আগে একটু পেছনে তাকানো যাক। ৭ই জানুয়ারি ২০২৪ অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। এই নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকমাস নিয়মিত যাতায়াত ছিল জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে। 


ওরে নাটক... এই শুনি নির্বাচনে যাবো না। আবার বিক্রি শুরু হলো নমিনেশন ফরম। আবার ঘোষণা এলো ৩০০ আসনে নির্বাচন করবে। এবার শুরু হলো দেন-দরবার। সেখানে কতোটি আসন বাগিয়ে নেয়া যায়। হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান। আর কোনো কথা নাই, দেখা নাই। অদ্ভুত এক সময়। শেষ পর্যন্ত ২৬টি আসনে সরানো হলো আওয়ামী লীগের প্রার্থী। কান পাতলে শোনা যায়, স্ত্রীর আসনের জন্য শেষ পর্যন্ত হয়েছে দেন- দরবার। এরশাদ পত্নী রওশন এরশাদ, এরশাদপুত্র সাদ এরশাদ এলেন না নির্বাচনে। মহাসচিব পোস্টারে লিখলেন- আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী। 


যাক আওয়ামী লীগ ছাড়া সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পেলো মাত্র ১১ আসন। এনিয়ে আলোচনা করতে গেলে শেষ হবে না। তারপরও বলতে হয়, জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের পদত্যাগ ও বহিষ্কারের হিড়িক লেগে গেল। অদৃশ্য এক ক্ষমতায় সামনে এলেন রওশন এরশাদ। নির্বাচন করা নেতারা টাকার ভাগ চাইলেন সংবাদ সম্মেলন করে। নির্বাচন নিয়ে নানান কথা বললেও, ঠিকই বিরোধীদলীয় নেতা হলেন জিএম কাদের। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হওয়ার পরও বহাল তবিয়তে রইলেন মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। দলটির নেতাদের দীর্ঘদিনের বিরোধী দলে থাকার অভিনয়... কেয়া বাত, কেয়া বাত।


৫ই আগস্ট পরবর্তী জাতীয় পার্টি- এ যেন ঢাল তলোয়ারহীন সৈনিক। আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হয়েও বীরদর্পে মুখ চালাতে লাগলেন চেয়ারম্যান। জাতীয় পার্টির গণমাধ্যমকর্মীদের তথ্য দেয়ার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ‘জাপা নিউজ’। একটু চোখ রাখলাম সেখানে। গত ১০ই মে জিএম কাদের বলেন, কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয় জাতীয় পার্টি। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করতে চায় এমন কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমরা নই। এখানে ২০২৪ সালের নির্বাচনে জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। আবার বলা হয়, নির্বাচনে গিয়ে কোনো বেআইনি কাজ করিনি।


আবার প্রায়শই জিএম কাদের একটা বিষয় বারংবার বলে আসছেন, সরকার দেশের ৫০ ভাগ মানুষকে বাদ দিয়ে সংস্কার প্রস্তাব করছে। একথায় তিনি কী বোঝাতে চান? তিনি কী আওয়ামী লীগের জনসমর্থন ৫০ শতাংশ বলে উল্লেখ করছেন?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবসময়ই একটা দ্বৈত অবস্থান ধরে রেখেছে দলটি। ১৯৮৬ সালে সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কর্তৃক গঠিত এই দলটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একদিকে যেমন ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে, তেমনি বিরোধী রাজনীতিতেও ছিল তার উপস্থিতি। সময়ের আবর্তে দলটি তার চরিত্র বদলেছে বহুবার। এটাই যেন দলটির প্রধান কাজ। ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন এবং গ্রেপ্তার হন। এরপর থেকেই জাতীয় পার্টি এক দ্বৈত বাস্তবতার মধ্যে পড়ে। হয়ে ওঠে কিংস পার্টির উৎকৃষ্ট উদাহরণ। 
এরশাদ জীবদ্দশায় দলটির একাধিকবার বিভাজন ঘটে- রওশন এরশাদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে ভিন্নমত গড়ে ওঠে। এমনকি এরশাদের মৃত্যুর পরও নেতৃত্ব নিয়ে বিতর্ক চলছে। ক’দিন পরপরই চেয়ার টানাটানি লাগে জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের মাঝে। 
২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলোতে জাতীয় পার্টি মূলত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের সহায়ক শক্তি হিসেবে অংশ নেয়। বিশেষত ২০১৪ সালে তো সংসদকে বৈধতা দেয় জাতীয় পার্টি। 


দলটির নেই কোনো আদর্শিক বাস্তবতা। দলটির আচরণ কখনো ইসলামপন্থি, কখনো ধর্মনিরপেক্ষ আবার বামের দিকেও ঝোঁক আছে। ক্ষমতার ছাতার ছায়ায় থাকাটাই মূল লক্ষ্য। 
বর্তমান বাস্তবতাতেও অস্পষ্ট দলটির আচরণ। গেল রমজানে বেশ কয়েকটি স্থানে ইফতার আয়োজনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। যদিও আঙ্গুল নানা দিকেই ঘুরানো যায়। আবার রাজনৈতিক ইস্যু খোঁজার চেষ্টা চলে গাজার পক্ষে মিছিল করতে না দেয়া নিয়েও।
জাতীয় পার্টি অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনাতেও ডাক পেয়েছিল। অংশও নিয়েছিল। জুলাই আন্দোলনের সৈনিকরা তাতে না করেন। নতুন মোড়কে আসে জাতীয় পার্টির অবস্থান। দিনে দিনে বেলা অনেকটাই গড়িয়েছে। এবার কী দলটি নিষিদ্ধ হবার পথে? 
এই তো ক’দিন আগে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে ‘জুলাই ঐক্য’। দুঃশাসনের মূল সহযাত্রী হিসেবে কাজ করা ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে ‘জুলাই ঐক্য’। নেতারা বলছেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনের মূল সহযাত্রী হিসেবে কাজ করা ১৪ দল এবং জাতীয় পার্টি এই রাজনৈতিক শক্তিগুলোও দায়মুক্তি পেতে পারে না। অবিলম্বে এসব দলের নিবন্ধন বাতিল ও নিষিদ্ধকরণ এবং বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানানো হয়।
জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ চেয়ে নির্বাচন কমিশনকে লিগ্যাল নোটিশও দেয়া হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধকরণের কথা।


জাতীয় পার্টিকে ঘিরে ‘নিষিদ্ধকরণ’ আলোচনা নতুন নয়। ৫ই আগস্টের পর থেকেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে চলছে। ইদানীংকালে এই সুর শক্তিশালী হয়েছে। আওয়ামী লীগ সাময়িক নিষিদ্ধের পরই জোর পড়েছে আলোচনায়। হয়তো চলে গেছে নীতিনির্ধারকদের টেবিলেও। ইঙ্গিত তো সেদিকেই যায়। 
নিষিদ্ধকরণের দাবি বাস্তবায়ন হবে কিনা, তা সময়ই বলবে। তবে জাতীয় পার্টির সামনে এখন একটি স্পষ্ট বাস্তবতা-কেবল অতীতের ছায়া নিয়ে টিকে থাকা যাবে না। রাজনৈতিক দলের বৈধতা আসে জনগণের আস্থা ও নৈতিক অবস্থান থেকে, যার অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। উল্টো জন্ম দেয় হাস্যরসের।
সামনে কী আসছে দলটির ভাগ্যে এটাই দেখার পালা।


লেখাটা শেষ করা যাক রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার এক বৃদ্ধের গল্প দিয়ে। তাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। তার নাম আসলাম।  এরশাদ ও লাঙ্গল বলতে পাগল।  ভীষণ ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন এরশাদকে। সাবেক এই প্রেসিডেন্টের রংপুর ঈদগাহ মাঠের জানাজায় তার কান্না অনেকেরই নজর কেড়েছিল। তিনি একটা কথা বলতেন- রংপুরের ছাওয়াক ভোট দেমো নাতো কাক দেমো? লাঙ্গল হামার মার্কা। লাঙ্গল মার্কাত যায় দাঁড়াক তাকে হামরা ভোট দেমো। 
গত ঈদে চাচার সঙ্গে কথা হলো। জাতীয় পার্টির কথা বলতেই, ভীষণ বিরক্ত। আসলাম চাচার মতো মানুষও যে জাতীয় পার্টি, লাঙ্গল বিমুখ হতে পারেন তা ভাবাই যায় না। তিনি বললেন, নেতারা হামার কথা ভাবে না। ওরা বউক এমপি বানাইলেই খুশি। তাওতো পারলো না। এরপর যা যা বলেছেন, তা লেখা যায় না। 

মতামত'র অন্যান্য খবর