কলকাতার চিঠি

কাশ্মীর সংকটে জাতিসংঘের ভূমিকা কী?

পরিতোষ পাল | আন্তর্জাতিক
মে ১০, ২০২৫
কাশ্মীর সংকটে জাতিসংঘের ভূমিকা কী?

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস উদ্বেগ প্রকাশ ছাড়া কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বলেছেন, বছরের পর বছর ধরে চলা বিরোধ এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানালেও তিনি শুধু মন্তব্য করেছেন, এই সংকটময় মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানের জন্য এমন সামরিক সংঘাত এড়ানো অত্যন্ত জরুরি যা সহজেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।


ইতিমধ্যেই ভারত প্রতিশোধের উদ্দেশ্য নিয়ে পাকিস্তানে নয়টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। আর এই হামলাকেই পাকিস্তান জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ভারতের অপারেশন সিঁদুরের প্রতিক্রিয়ায় সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে বলেন যে, ভারত জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছে। এক বিবৃতিতে  ইসহাক দার বলেছেন, জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদ অনুসারে এবং আন্তর্জাতিক আইনে বর্ণিত হিসেবে পাকিস্তান তার পছন্দের সময় এবং স্থানে যথাযথ প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার সংরক্ষণ করে। সোজাকথায় জাতিসংঘকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে ভারতের হামলার জবাব দেয়ার কথা জানিয়েছে পাকিস্তান। এবং পরবর্তী সময়ে ভারতের হামলার জবাবও দিয়েছে। অন্যদিকে ভারতও হামলার ক্ষেত্রে জাতিসংঘকেই আশ্রয় করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ভারতের প্রত্যাঘাতকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন,  ‘অপারেশন সিঁদুর’ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই করা হয়েছে। যা করা হয়েছে, ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ অনুযায়ী করা হয়েছে। এই অভিযান ‘মাপা’, ‘নিয়ন্ত্রিত’, ‘দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন’, ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ’ এবং ‘সংঘাতবর্ধক’ নয়। তিনি বলেছেন, ২৫শে এপ্রিল জাতিসংঘ পেহেলগামে হামলার তীব্র নিন্দা করে বলেছিল, অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ভারতের এই প্রতি-আক্রমণ তারই সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এটি শুধুই প্রতিশোধ নয়, বরং ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা।


কাশ্মীর বিরোধের এই জটিল পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের ভূমিকা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। আর তাই পাকিস্তানের অনুরোধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বর্ধিত বৈঠকে অনেক আলোচনার পরও কোনো প্রস্তাব গৃহীত হয় নি।
অথচ কাশ্মীর বিরোধের সঙ্গে জাতিসংঘ জড়িয়ে রয়েছে ১৯৪৮ সাল থেকে। ১৯৫১ সালের ৩০শে মার্চ থেকে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে   জাতিসংঘের নিরস্ত্র সামরিক পর্যবেক্ষক দল রয়েছে। এদের সদর দপ্তর রয়েছে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) এবং ভারতের শ্রীনগরে (মে থেকে অক্টোবর)। আনুষ্ঠানিকভাবে এই পর্যবেক্ষক দল এখনো সেখানে রয়েছে।


কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের এই সংঘাতের কারণ কি? কাশ্মীরের বিরোধে কীভাবেই বা জাতিসংঘ জড়িয়ে গিয়েছে? 
১৯৪৭ সালে ‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট’ নামে বৃটিশ ভারত বিভাগের যে পরিকল্পনা করেছিল তাতে বলা হয়েছিল, কাশ্মীর তার ইচ্ছা অনুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তান, যেকোনো রাষ্ট্রে যোগ দিতে পারবে। মুসলিম অধ্যুষিত  কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে অথবা ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে। অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালোচিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে। এই পরিস্থিতিতে ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের পাখতুন উপজাতীয় বাহিনীগুলোর আক্রমণের মুখে হরি সিং ভারতে যোগ দেয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এরপরেই ভারতের সামরিক বাহিনী সেখানে অবস্থান নেয়। ফলে ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, যা চলেছিল প্রায় দু’বছর ধরে।
ভারতই জাতিসংঘকে এই বিরোধে ডেকে এনেছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ১৯৪৮ সালে ভারত কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। জাতিসংঘের ভারত ও পাকিস্তান কমিশন গঠনের পর, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৪৮ সালের ২১শে এপ্রিল ৪৭ নম্বর প্রস্তাব পাস করে। তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি আরোপ করা হয় এবং পাকিস্তান সরকারকে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য থেকে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে আসা উপজাতি এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের প্রত্যাহার নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি ভারত সরকারকে তার সেনাবাহিনীকে সর্বনিম্ন শক্তিতে কমিয়ে আনারও অনুরোধ করা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ভারত বা পাকিস্তানে রাজ্যের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের পরিস্থিতি কার্যকর করার কথাও বলা হয়। কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় ১৯৪৮ সালে। তবে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। তখন থেকেই কাশ্মীর কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়।
তবে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিরাপত্তা পরিষদ সেখানে সামরিক পর্যবেক্ষক দল নিয়োগ করে। এই দলের কাজ হলো যুদ্ধ বিরতি লঙ্ঘন হলে তা নিরাপত্তা পরিষদে জানানোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।


এরপর থেকে কাশ্মীর বিরোধ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আরও দুটি যুদ্ধ ও অসংখ্য ছোট ছোট সংঘর্ষ হয়েছে।  
তবে বর্তমানে জম্মু ও কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে ভাগ হয়ে রয়েছে। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্যদিয়ে চীন কাশ্মীরের আকসাই-চীন অংশটিতে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। আর তার পরের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স-কারাকোরাম অঞ্চলটি চীনের হাতে তুলে দেয়।
১৯৬৫ সালে দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়  আরেকটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল। এরপর ১৯৭১-এর তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭২-এর সিমলা চুক্তির মধ্যে দিয়ে বর্তমানের ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বা নিয়ন্ত্রণরেখা চূড়ান্ত রূপ নেয়। ১৯৮৪ সালে ভারত সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ দখল করে, যা নিয়ন্ত্রণরেখা দিয়ে চিহ্নিত ছিল না। ১৯৯৯ সালে ভারত কারগিলে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ জড়িয়েছিল।     


১৯৮৯ সালে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর উপত্যকায় ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয় আর সেই বিদ্রোহে প্রথম থেকেই পাকিস্তান লজিস্টিক সহায়তা দিয়ে এসেছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবির ভিত্তিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবিদার একটি গোষ্ঠীর নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার প্রথম কয়েক বছরের মধ্যেই পাকিস্তান-সমর্থিত জিহাদি গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালায়।  ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে এই বিদ্রোহের আগুনকে জ্বালিয়ে রেখেছিল মূলত বিদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো। এর ফলে ভারতের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। আর এই ভাবেই ক্ষোভের আগুন পুঞ্জীভূত হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে মুসলিম প্রধান কাশ্মীর উপত্যকা থেকে কাশ্মীরি হিন্দুদের দেশত্যাগের মতো ঘটনাও ঘটেছিল। 


সন্ত্রাসবাদকে মোকাবিলা করতে গিয়ে ভারতের সেনাবাহিনী সেখানে দমনমূলক নীতি কায়েম করেছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগে সরব হয়েছিল কাশ্মীরি যুবসমাজ। ব্যাপক সামরিকীকরণেও ব্যবস্থা করেছিল ভারত সরকার। এক সময় কাশ্মীর উপত্যকার  নাগরিক অস্থিরতা তীব্র আকার ধারণ করেছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীরে মোতায়েন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্যের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বেসামরিক আদালতে বিচার করা হয়নি, যদিও সামরিক আদালতে কোর্ট মার্শাল অনুষ্ঠিত হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ভারত সরকারকে এই অঞ্চলে  নির্যাতনের অপরাধীদের বিচার করতে অস্বীকৃতি জানানোর অভিযোগও করেছে। অন্যদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস ২০০৬ সালে বলেছিলেন, যদিও ‘আজাদ’ অর্থ ‘মুক্ত’, কিন্তু আজাদ কাশ্মীরের বাসিন্দারা স্বাধীন নয়। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ মৌলিক স্বাধীনতার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ সহ আজাদ কাশ্মীর শাসন করে। 


২০১৪ সালে ভারতে হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তারা পাকিস্তানের ব্যাপারে কঠোর নীতি নেয়ার অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও শান্তি আলোচনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলেন অতিথি হিসেবে।
কিন্তু এর এক বছর পরই পাঞ্জাবের পাঠানকোটে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ হয়, যার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসী  গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করে ভারত।   ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ভারতের একাধিক সামরিক ঘাঁটির ওপর হামলা হয়েছে। ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় এক সন্ত্রাসী হামলায় ৪০ জনেরও বেশি নিরাপত্তা বাহিনীর  সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে  তৈরি হয়েছে তীব্র উত্তেজনা। ফলে দু’দেশের মধ্যে আলোচনায় এরপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। সম্ভাবনাও নেই। বরং উভয় পক্ষে চলেছে কথার লড়াই। হুমকি ও পাল্টা হুমকির চক্রানিনাদে বার বার কাঁপন ধরানোর চেষ্টা করে চলেছে। শেষ পর্যন্ত পেহেলগামে ২৬ নিরপরাধ পর্যটকের নৃশংস হত্যা সত্যি সত্যি কাঁপন ধরিয়েছে। এবারো অভিযোগ পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীদেরই কাজ এটি। তার বদলা নিয়েছে ভারত পাকিস্তানের সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে।  


দু’টি দেশই পরমাণু শক্তিধর হওয়ায় সবাই শঙ্কিত হয়ে রয়েছেন। আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠেছে। বিশ্ব নেতারা মুখে শুধু সংযমের বাণী আওড়ে চলেছেন। আবার এমনও বলছেন, এই বিরোধে তাদের কিছু করার নেই। আর নামকাওয়াস্তে সামরিক পর্যবেক্ষক রেখে জাতিসংঘ অপদার্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। ১৯৭২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কোনো প্রস্তাব নিতে পারেনি এই বিরোধ নিয়ে। বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘদিন স্থায়ী এই বিরোধ নিয়ে জাতিসংঘের অসহায়তায় কেউই বিচলিত নয়। আর তাই আজ ভারতও কাশ্মীর থেকে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের দপ্তর গুটিয়ে নেয়ার কথা ভাবছে। বর্তমানে পরিস্থিতি  যা দাঁড়িয়েছে তাতে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা সহজে ফিরে  আসার সম্ভাবনা নেই। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই গোটা উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। যার মাশুল গুনতে হবে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষকেই। 

আন্তর্জাতিক'র অন্যান্য খবর