অ র্থ নী তি

শেয়ারবাজারের মন্দাভাব কাটবে কী করে?

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ | মতামত
মে ১০, ২০২৫
শেয়ারবাজারের মন্দাভাব কাটবে কী করে?

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে চরম মন্দাভাব চলছে। দৈনিক লেনদেন একেবারে তলানিতে। শেয়ারবাজারের পরিভাষায় একে  বেওয়ারিশ অবস্থা বলা হয়। বাজার চাঙ্গা থাকলে সেটা বুল মার্কেট। শেয়ারবাজারের এই খেলা বা লড়াইকে বুল বিয়ার পাইট বা ষাঁড়-ভালুকের লড়াই। প্রথমেই শেয়ার মার্কেট তথা ক্যাপিটাল মার্কেট সম্বন্ধে কিছু বলতে হয়। শেয়ার মার্কেটের গর্ব হলো যে, এখান থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সরবরাহ করা হয় যা দেশের উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হয় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সহায়ক। শেয়ার আকারে এই অর্থ সংগ্রহ করা হয় যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পুঁজি হিসেবে কাজ করে। এভাবে দীর্ঘ দিন ধরে শেয়ার গোটা বিশ্বে উন্নয়ন তথা জিডিপি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে আসছে। এই শেয়ারবাজারের দুটো স্তর রয়েছে, তবে তারা উপর-নিচ নয়, সমান্তরাল তথা সম্পূরক। একটিকে বলা হয় প্রাইমারি মার্কেট,  অপরটি স্টক এক্সচেঞ্জের ট্রেডিং ফ্লোর। প্রাইমারি মার্কেটে শেয়ার নির্দিষ্ট মূল্যে বিক্রয়ের জন্য সম্ভাব্য ক্রেতাদের আহ্বান জানানো হয়। যাকে বলা হয় আইপিও অর্থাৎ প্রাথমিক গণআহ্বান। আর আইপিওতে প্রাপ্ত শেয়ার বিক্রয়ের প্রয়োজনে স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন করা হয়। অতএব প্রাইমারি মার্কেটের অর্থ সরাসরি জাতীয় উন্নয়নের অর্থ প্রবাহে যোগ দেয়। আর স্টক এক্সচেঞ্জে যে অর্থ লেনদেন হয় সেটা কোথায় যাবে তা ক্রেতা-বিক্রেতারা জানে। অতএব প্রাইমারি মার্কেটের পুঁজিবাজারের প্রাণ। তবে এরা একে অপরের সম্পূরক এজন্য যে যদি সেকেন্ডারি মার্কেটে যদি শেয়ার মালিকরা ঠিকমতো বিক্রি করতে পারে তারা অধিক আগ্রহী হবে প্রাইমারি মার্কেটে যেতে।


বাংলাদেশের প্রাইমারি মার্কেটকে এক সময় বলা হতো গোল্ডমাইন। ১৯৮৭ সালে যখন বিশ্বব্যাপী বিরাষ্ট্রীয়করণের হাওয়া ভালোভাবে বইছে, তখন বাংলাদেশেও তার দোলা লাগে। সরকার বেশ কয়েকটা রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির আংশিক শেয়ার আইপিও’র মাধ্যমে বাজারে ছাড়ে এবং বিপুল সাড়া পড়ে। সেই সঙ্গে কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইপিও’র আশ্রয় নেয়। একটি লাভজনক ঔষধ শিল্প শতকরা ৮০ ভাগ প্রিমিয়াম আইপিওতে শেয়ার ছাড়ে। তা সত্ত্বেও প্রয়োজনের অধিক আবেদন পড়ে। অনাবাসিক অর্থাৎ বিদেশিদের শেয়ারবাজারে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার পর বাজার আরও চাঙ্গা হয়ে উঠে। এরপর বেদনাদায়ক ঘটনা হলো ১৯৯৬ এবং ২০০৯-১০ সালে ভয়াবহ শেয়ার কেলেঙ্কারি হয় এবং ধস নামে। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে এর বিশদ বর্ণনা দেয়া সম্ভব না। তবে খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয় বিএসইসি, স্টক এক্সচেঞ্জের শতভাগ প্রশাসনিক ব্যর্থতা, কিছু সংখ্যক উদ্যোক্তা এবং স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যদের অসততা। দ্বিতীয় কেলেঙ্কারিতে কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক খলনায়কের ভূমিকা পালন করেছিল। স্টক এক্সচেঞ্জের জন্মলগ্ন থেকেই অনেক কেলেঙ্কারি রয়েছে, চরম দুর্নীতি হয়েছে। ১৭২৪ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে মহাদুর্নীতি হয়েছিল।  বৃটিশ পার্লামেন্ট তদন্ত করার পর তাদের অর্থমন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা পায় এবং তাকে জেলে পাঠানো হয়। আমাদের দেশের বিচারহীনতার ঐতিহ্যের কারণে এধরনের ব্যবস্থা স্বপ্নাতীত।


এসব ঘটনার ফলে শেয়ারবাজার থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কেটে পড়তে লাগলেন। সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব হলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু আমাদের কর্তৃপক্ষ এমন ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন যে, লোক আরও পালাতে লাগলেন। স্টক এক্সচেঞ্জের কিছু বিধান রয়েছে যা সাময়িকভাবে ব্যবহার করা হয়। যেমন ফেয়ার প্রাইজ নির্ধারণ। হঠাৎ ধস নামা শুরু হলে কিছু ভালো শেয়ারের একটা মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এভাবে এর নিচে মূল্য আসলে বিক্রি করা যাবে না। বিএসইসি এই বিধানটি প্রয়োগ করলেন এবং দীর্ঘদিন তা চালানো হলো। অথচ একজন বিনিয়োগকারীর মৌলিক অধিকার তার শেয়ার তিনি ইচ্ছামতো ক্রয়-বিক্রয় করবেন। এই বিধানটি দীর্ঘদিন চালানোর ফলে সামগ্রিকভাবে শেয়ারবাজারের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আর একটি ভয়াবহ নিয়ম চালু করা হয়েছে। তাহলো কেউ আইপিওতে আবেদন করতে চাইলে তাকে শেয়ারবাজার থেকে কিছু শেয়ার কিনতে হবে।  এ এক অদ্ভুত  নেতিবাচক বিধান। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক চেয়ারম্যান আহমদ ইকবাল হাসান সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, বিশ্বের কোথাও এরকম বিধান আছে কিনা। বিরাট এক দল নিয়ে বিএসইসি ইউরোপ এবং আমেরিকায় রোডশো করে এলো উদ্দেশ্য বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেটকে চাঙ্গা করার। কিন্তু কর্তারা কি দ্রব্য নিয়ে গিয়েছিলেন, তা তারাই জানেন। তবে এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশ পুঁজিবাজারের এতটুকু কল্যাণ হয়নি।


বাংলাদেশ শেয়ার মার্কেট তথা পুঁজিবাজারকে সক্রিয় করার একটাই পথ তাহলো আইপিও মার্কেট সক্রিয় করা। গত এক বছর একটি আইপিও বাজারে আসেনি। তাহলে নতুন বিনিয়োগকারী তো দূরের কথা পুরাতনরা চলে যাবে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বিও অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে এটাই চূড়ান্ত প্রমাণ যে, বিনিয়োগকারীর সংখ্যা অব্যাহত ভাবে কমে যাচ্ছে। অবিলম্বে সরকারের দায়িত্ব তার হাতে যে শেয়ার রয়েছে সেসব ছেড়ে দেয়া। আগে অবশ্য তৎকালীন অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন সরকারি শেয়ার ছেড়ে দেবেন। পরে শোনা গেল যে, একজন সমাজতন্ত্রী যিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে তিনি বাধা দিয়েছেন। দেশের হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, লুটের বন্যা বয়ে চলেছে, আর মন্ত্রী মহোদয় ক’টা শেয়ার আটকিয়ে রেখে সমাজতন্ত্র কায়েম করবেন। তার এই সমাজতন্ত্র প্রীতির তারিফ করতে হয় বৈকি?  বেসরকারি ব্যবসায়ীদের ভেতরেও আইপিও’র প্রতি আগ্রহ তুলনামূলকভাবে বেশ কিছু গ্রুপ অফ কোম্পানি গড়ে উঠেছে। তাদের ভেতর ভালো কোম্পানি রয়েছে। কিন্তু ২/১টির বেশি কোম্পানিকে তারা পাবলিকে আনেননি। সব সরকারি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। তারপরও আরও কিছু সুযোগ-সুবিধার বিষয় থাকে, তাহলে সরকারের সঙ্গে কথা বলে তারা এগিয়ে আসতে পারেন। মিডিয়া রিফর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন যে, এক ডজনের বেশি পত্রিকার অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য ভালো। কিন্তু একটি পত্রিকাও স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়নি। এদিকে একটি পত্রিকা রয়েছে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। বছরে শতকরা ৫০/৬০ ভাগ লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। সেই পত্রিকাটি পাবলিকে যেতে পারে। বেসরকারি ব্যবসায়ীদের মাঝে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি গড়ে তোলার সংস্কৃতিকে সক্রিয় করা দরকার। আমাদের শেয়ারবাজারকে আমাদের সক্রিয় করতে হবে। এর জন্য আইপিও’র বাজার জোরদার করতে হবে। বর্তমানে প্রবাসীরা যেভাবে অর্থ প্রেরণ করে রিজার্ভকে শক্তিশালী করছেন, তাতে অর্থ উপদেষ্টা নিজের উপর অগাধ আস্থা পেয়েছেন। যার ফলে তিনি বলছেন যে, আইএমএফের সঙ্গে তিনি তাদের টার্ম নয় নিজের টার্মে কথা বললেন।


প্রস্তাব করা হয়েছে যে, বর্তমানে পুঁজিবাজার শুধু শেয়ারের উপর নির্ভর করে রয়েছে। বাজার বহুমুখী করতে হবে। ফিউচার, অপশন এবং আরও অনেক আর্থিক ইন্সটুমেন্ট বের হয়েছে। তা হয়তো ঠিক। কিন্তু এর অন্যদিকও রয়েছে, অর্থের ঐতিহাসিক দায়িত্ব ছিল যে সমাজের পরিসেবা প্রদান এবং তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সম্পদ সৃষ্টি করা। যার ফলে রাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি তথা জিটিপি বৃদ্ধি পায়। এখন অর্থ থেকে অর্থ অর্জন করা। যাকে বলা হয় ফাইন্যাসিয়ালিজম বা অর্থবাদ। অর্থবাদ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে একে বলা হচ্ছে অভিশাপ। তবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, অন্য আর্থিক ইন্সটুমেন্ট আসুক না কেন আইপিও’র ভূমিকা অন্যান্য। অর্থনীতিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হলে আইপিও-কে শক্তিশালি করার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।


এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলা প্রয়োজন। স্টক এক্সচেঞ্জে যখন অযৌক্তিকভাবে শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে তখন সংশ্লিষ্ট সকলের কর্তব্য বাজারকে শীতল করার। সে সময় একদল শেয়ারবাজারে পণ্ডিতের আগমন হয় যারা সরকারের নিকট তথা ব্যাংকের নিকট আহ্বান জানান অর্থযোগান দেয়ার জন্য। তারা মনে করেন যে, আকাশ শেয়ারের মূল্যের সীমারেখা। এদের হাত থেকে শেয়ারবাজারের পরিত্রাণ পাওয়া বাঞ্ছনীয়। পুঁজিবাজারের পরিত্রাণ পাওয়া বাঞ্ছনীয়। পুঁজিবাজার শাস্ত্রের অন্যতম পরামর্শ ধার করা টাকা দিয়ে শেয়ার ক্রয় করবেন না। মার্চেন্ট ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের ঋণ প্রদান করে মার্কিন মানি হিসেবে। সেক্ষেত্রে বেশ কিছু কড়া বিধিনিষেধ রয়েছে যাতে মার্জিন মানির পরিমাণ বেশি না বেড়ে যায়। পরিশেষে যারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে আসেন তাদের আরও কয়েকটি কথা মনে রাখা দরকার। বলা হয়ে থাকে যে, সব ডিম এক বাক্সে রাখবেন না। অর্থাৎ একাধিক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করবেন। একটু দীর্ঘ সময়ের জন্য বিনিয়োগ করবেন। অতি মুনাফার প্রত্যাশা করবেন না। 

মতামত'র অন্যান্য খবর