কলকাতার চিঠি

ভারত ও পাকিস্তান কি সামরিক সংঘাতের পথে?

পরিতোষ পাল | আন্তর্জাতিক
এপ্রিল ২৬, ২০২৫
ভারত ও পাকিস্তান কি সামরিক  সংঘাতের পথে?

সেয়ানে সেয়ানে লড়াই চলছে। কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলায় ২৮ জন নিহত হওয়ার ঘটনাটি ভারতে সকল দেশবাসীকে জাতীয়তা বোধে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছে। দেশটির বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের যেকোনো পদক্ষেপে সমর্থন জানানোর কথা জানিয়েছে। 
সাড়ে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে সন্ত্রাসে সন্ত্রাসে পর্যুদস্ত কাশ্মীর। কিন্তু এবারের সন্ত্রাসী  হামলা অতীতের সব অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে গিয়েছে এর  ভয়াবহতায়, উন্মাদ হিংস্রতায়। পহেলগাঁওয়ের কাছে ‘মিনি সুইজারল্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত বৈসরণ উপত্যকায় এক অভূতপূর্ব অমানবিকতার নজির তৈরি করেছে সন্ত্রাসবাদীরা।  আর এই নির্মমতার দায় নিয়েছে লস্কর-ই-তৈয়বা’র ছায়া সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফোর্স (টিআরএফ)। পাকিস্তান অবশ্য জঙ্গিদের কোনো ধরনের সহায়তা দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে তারা বলছে, কাশ্মীরিদের ‘স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে’ তারা নৈতিকভাবে সমর্থন করে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির কাশ্মীরকে পাকিস্তানের ‘জাগুলার’ (‘জাগুলার’ মানে গলার শিরা বা জাগুলার ভেইন। এটি শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রক্তনালিগুলোর একটি। কথ্য ভাষায় বা রাজনৈতিক ভাষণে ‘জাগুলার’ বলতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, জীবন-মরণের প্রশ্ন বা সবচেয়ে দুর্বল ও সংবেদনশীল জায়গাকে বোঝায়) বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের কাশ্মীরি ভাইদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে একা ফেলে দেবো না।’


ভারতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কেবল নিরীহ পর্যটকদের ওপর হামলা ছিল না; এটি কাশ্মীরকে একটি নিরাপদ এবং এমনকি জনপ্রিয় পর্যটন স্থান হিসেবে ধারণার উপর একটি ইচ্ছাকৃত আক্রমণ ছিল। এই হামলায় যুক্ত সন্ত্রাসী এবং এর নেপথ্য মদতদাতাদের অকল্পনীয় শাস্তির মুখোমুখি করার কথা বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারত ইতিমধ্যে কূটনৈতিক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু চুক্তি বাতিলসহ একগুচ্ছ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পূরকের মান নামিয়ে এনেছে। পাকিস্তানও পাল্টা প্রত্যাঘাত হেনেছে। সিন্ধু নদের পানিবণ্টন ব্যাহত হলে তা যুদ্ধের শামিল বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ভারতের সঙ্গে সব রকমের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পাশাপাশি সিমলা চুক্তি বাতিল করার ইঙ্গিতও দিয়েছে পাকিস্তান। ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শান্তিচুক্তি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয়  সেনাবাহিনীর হাতে পাকিস্তানের পরাজয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশের পর হিমাচল প্রদেশের শিমলায় ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল জম্মু ও কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতির ফলে যে নিয়ন্ত্রণরেখা নির্ধারিত হয়েছে, ভারত এবং পাকিস্তান, উভয় পক্ষই তা মেনে চলবে। পারস্পরিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও  কোনো পক্ষ একতরফা ভাবে এর পরিবর্তন চাইবে না। তারপরেও অবশ্য পাকিস্তান একাধিক বার এই শর্ত লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ। তবে এখন চুক্তি স্থগিত রাখার ঘোষণা হলে এরপর ভারত-পাক নিয়ন্ত্রণরেখাকে মান্যতা না-দিয়ে সীমান্তে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা হতে পারে।


ভারতের সাবেক কূটনীতিক সৈয়দ আকবরউদ্দিনের মতে, পাকিস্তানের ঘোষণা ইঙ্গিত দিয়েছে যে, দ্বিপক্ষীয় মতবিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের চুক্তিকে পাকিস্তান আর বাধ্যতামূলক প্রতিশ্রুতি হিসেবে বিবেচনা করছে না। এটি নিয়ন্ত্রণ রেখার বৈধতা উন্মুক্ত করার চেষ্টা,  যা উভয় পক্ষ ১৯৭২ সাল থেকে মেনে আসছে। 
ভারতের অনেকে ২০১৯ সালের পুলওয়ামার সময়ে হওয়া সার্জিকাল স্ট্রাইকের মতো আবার  একটি সার্জিকাল স্ট্রাইকের কথা বলছেন। তবে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধরনের সার্জিকাল স্ট্রাইকের কোনো অর্থ নেই। বরং সন্ত্রাসবাদকে মদত দিচ্ছে যারা তাদের ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া দরকার। 
তবে গত কয়েকদিন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার পারদ যেভাবে চড়ছে তাতে উদ্বিগ্ন জাতিসংঘের মহাসচিব দুই দেশকেই সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আবেদন করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাকিস্তান ছেড়ে কথা বলতে চাইছে না। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক লেখক ও দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, আমরা দেখছি, দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী এখন একে অপরের দিকে আক্রমণাত্মক চোখে তাকিয়ে আছে। এখন কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়।  


কাশ্মীরে সহিংসতা চলছে পঞ্চাশের দশকের পর থেকেই। হিন্দুপ্রধান ভারত ও মুসলিমপ্রধান পাকিস্তান-দুই দেশই এই অঞ্চলকে নিজেদের দাবি করে আসছে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর থেকে কাশ্মীরের একটি বড় অংশ পাকিস্তানের দখলে রয়েছে। ১৯৮৯ সালে ভারতের বিরুদ্ধে  সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে হাজার হাজার মানুষ কাশ্মীরে নিহত হয়েছেন। তবে সামপ্রতিক বছরগুলোতে সহিংসতা অনেকটাই কমে গিয়েছিল। 


২০১৯ সালে বিজেপি সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করে দেয় এবং রাজ্যকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে। কাশ্মীরকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে আরও বেশি সংযুক্ত করার লক্ষ্যে বাইরের লোকদের কাশ্মীরে জমি কেনার অনুমতিও দেয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের দায় নেয়া দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ করেছে, ৮৫ হাজারের বেশি ‘বহিরাগত’ এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে, যা জনসংখ্যাগত উপাত্তে পরিবর্তন আনছে। তবে ভারত কাশ্মীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে যে প্রচার করেছিল তা যে সঠিক ছিল না তা কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সোজাসুজি বলেছেন। ভারত সরকারও সর্বদলীয় বৈঠকে তাদের তরফে যে ভুল ছিল তা স্বীকার করেছেন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও এই ব্যর্থতার দায় অস্বীকার করতে পারে না বলে রাজনৈতিক দলের নেতাদের অভিমত। 

  
তবে ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমিতাভ মাট্টু বলেছেন, জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলা কেবল বর্বরতার কাজ নয়। এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক সংকেত, সতর্কতার সঙ্গে সময়োপযোগী এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বেছে নেয়া হয়েছে যাতে কেবল মানুষ হতাহতই হয় না, বরং কৌশলগত ব্যাঘাতও ঘটে। তার মতে, এটি কোনো এলোমেলো বা মরিয়া হামলা নয়। এটি পাকিস্তানি সামরিক-গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের নির্দেশিত এবং টিকিয়ে রাখা আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের দীর্ঘস্থায়ী ধরনটির ধারাবাহিকতা বলে মনে হচ্ছে। পাকিস্তান যখন ভারতের কূটনৈতিক রাডার এবং পররাষ্ট্রনীতির কল্পনা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, তখন এটি ফিরে এসেছে।
ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অভিযোগ, পাক নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারত বিদ্রোহীদের গোপনে মদত দিয়ে চলেছে। সমপ্রতি সেখানে পর পর বেশ কিছু সরকারবিরোধী আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। বালোচ বিদ্রোহীরা একটি ট্রেনকে জিম্মি করেছিল। এই সব ঘটনায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নানা সংকট ঘনীভূত হয়েছে। এই অবস্থা থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই আজকে ভারতবিরোধী নতুন নতুন জিগির তোলা হচ্ছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ পহেলগাঁওয়ের হত্যাকাণ্ডকে ভারতের “স্বদেশে জন্মানো” এবং ভারতের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বিদ্রোহের অংশ বলে বর্ণনা করেছেন। অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, পাক সেনাপ্রধান মুনিরের সামপ্রতিক কাশ্মীর নিয়ে বক্তব্য সন্ত্রাসীদের উস্কানির জন্য যথেষ্ট ছিল। ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তান নিরবচ্ছিন্নভাবে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসে মদত দিয়ে চলেছে।


পহেলগাঁওয়ের হত্যাকাণ্ড যে নিখুঁত পরিকল্পনা করেই করা হয়েছিল তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এখন পর্যন্ত পাওয়া নানা তথ্য-উপাত্ত থেকে। এর পেছনে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীরা রয়েছেন বলেও ভারত দাবি করেছে।
তরে পরিস্থিতি যত দিন যাবে ততই এই অঞ্চলে উত্তাপ বাড়বে বই কমবে না। সিন্ধু নদের পানি বণ্টন বাধাপ্রাপ্ত হলে তা পাকিস্তানের কাছে সমূহ বিপদের বার্তা দেবে। কেননা, সিন্ধু পানিচুক্তির মধ্যদিয়ে বিশ্বের অন্যতম বড় নদীব্যবস্থার পানিবণ্টন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই নদ ভারতের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করে এবং দুই দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনধারণে এর প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের মানুষ এই পানির উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। অন্যদিকে সিমলা চুক্তি বাতিল হলে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) মানার জন্য দুই দেশ যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তা আর কার্যকর থাকবে না। ফলে সীমান্তে অশান্তি অবধারিত। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে  গেছে দুই দেশের মধ্যে গোলাগুলি। 
তবে ভারত শেষ পর্যন্ত সামরিক সংঘাতের পথ বেছে নেবে কিনা  তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতি যত আগ্রাসী হবে তখন ভারত বসে থাকতে পারবে না। একবার যদি উত্তেজনার পালা শুরু হয়, তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে ধরনের আগ্রাসী মানসিকতার মানুষ তিনি কোন পথে পা বাড়াবেন তা বোঝা কষ্টকর। 

আন্তর্জাতিক'র অন্যান্য খবর