সংস্কার, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ ও জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন সরগরম। এই উত্তাপের ঢেউ লেগেছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের সর্বত্র। আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনার বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে নির্বাচন, সংস্কার ও হঠাৎ করেই রাজধানীতে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল এবং ফ্যাসিবাদের বিচারের ইস্যুটি। রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে, বক্তব্য-বিবৃতিতে এমনকি কূটনৈতিক পর্যায়ে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কোনো না কোনোভাবে সংস্কারের বিভিন্ন দিক এবং জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংস্কার-নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম ইত্যাদি নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাক্ষাৎকার, সংবাদ ও নিবন্ধ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোড ম্যাপ ঘোষণা না করা হলেও গ্রামেগঞ্জে নির্বাচনী তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। ঈদুল ফিতর, বাংলা নববর্ষ সহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসকে ঘিরে সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থীরা কৌশলে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে গ্রামে-গঞ্জের হাট-বাজারে সকাল-সন্ধ্যার চা আড্ডায় প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে নির্বাচন ও সংস্কার। একে অপরের সঙ্গে বিজ্ঞজনের মতো আলোচনা-পর্যালোচনা করেছেন বিএনপি’র দাবি অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কিনা? এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিশ্রুত ডিসেম্বর থেকে আগামী ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে আদৌও নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা আছে কিনা? নাকি সংস্কার ইস্যুটি সামনে রেখে কালক্ষেপণের কৌশল অবলম্বন করে নবগঠিত রাজনৈতিক দলগুলোকে সময় করে দেবে একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নির্বাচনের মাঠে নামার জন্য। অতীত অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বক্তব্য-বিবৃতি বিশ্লেষণ করে অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, যে যা-ই বলুক অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বাড়বে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশ ভালোই চালাচ্ছেন। রমজানে দ্রব্যমূল্য ও বিদ্যুতের লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে ছিল। তুলনামূলক ভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা উন্নতি হচ্ছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অগ্রগতি হচ্ছে। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণ সফলভাবে মোকাবিলা করছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের পরিপূরক হিসেবে সংস্কারকে সামনে আনার চেষ্টা চলছে। সংস্কার ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আয়েশি ভঙ্গিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিএনপি সহ কিছু রাজনৈতিক দল দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের তাগিদ দিলেও কতিপয় রাজনৈতিক দল সংস্কার কার্যক্রমে সরকারের এই আয়েশি ভাবকে দারুণ ভাবে এনজয় করছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ১০ই মার্চ ছয়টি সংস্কার কমিশনের ১৬৬ সুপারিশ ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনসহ প্রশ্নমালা ও স্প্রেডশিট ৩৪টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠিয়েছে। সংস্কার বিষয়ে প্রস্তাবিত ১৬৬ সুপারিশের মধ্যে বিএনপি’র পক্ষ থেকে বিচার বিভাগ সংস্কারের ২৩ সুপারিশের মধ্যে ২০টিতে বিএনপি একমত। দুদক সংস্কারের ২০ সুপারিশের ১৯টিতে একমত ও আংশিক একমত। জনপ্রশাসনের সংস্কারের ২৬ প্রস্তাবের অর্ধেকের বেশি বিষয়ে দলটি একমত, বাকিগুলোর বিষয়ে মন্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ১১৩টিতে একমত হয়েছে। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ১২০টিতে একমত পোষণ করেছে। এই পর্যায়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেছে। বৈঠকে সংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিমত পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বর্তমান বাস্তবতায় বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়সীমা নিয়ে একধরনের অস্থিরতা ও মতপার্থক্য প্রকাশ্যে চলে এসেছে। বিএনপি এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আগামী রমজানের আগেই জাতীয় নির্বাচন চায় উল্লেখ করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে বলে দাবি জানিয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচনের দিকে গেলে সে নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবে কি-না, সেটাও বিবেচনাধীন থাকবে বলে জানিয়েছেন। এনসিপি এখনো রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে এমন খবর পাওয়া যায়নি। বরঞ্চ নিবন্ধন পেতে আবেদন জমা দেয়ার সময় তিন মাস বাড়ানোর দাবি জানিয়ে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছে দলটি। চিঠিতে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের পর নতুন দল নিবন্ধন দেয়ার কার্যক্রম চালাতে ইসি’র প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি। এ পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদনের সময়সীমা দুই মাস বাড়িয়ে ২২শে জুন পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছে নির্বাচন কমিশন। এতে স্পষ্টতই বুঝা যায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়সীমা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে মতপার্থক্য ও একধরনের ধোঁয়াশা এবং ধূম্রজাল তৈরি হচ্ছে।
সমপ্রতি বিএনপি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বলেছে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। সরকারের পক্ষ থেকে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা এবং ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কার কার্যক্রম দৃশ্যমান করে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের আশ্বাস প্রদান করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন সংসদ নির্বাচন কোনোভাবেই জুনের (২০২৬ সালের) পর যাবে না। সরকারের এই আশ্বাসে বিএনপি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। বিএনপি মনে করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংস্কার একটি সদা চলমান অনিবার্য প্রক্রিয়া। বিএনপি ৫ই আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পূর্বেই ২০২৩ সালের ১৩ই জুলাই ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন। সংস্কার প্রশ্নে বিএনপি’র বক্তব্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো দ্রুত সম্পন্ন করে নির্বাচন দিতে হবে এবং অবশিষ্ট যে সমস্ত সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ঐকমত্য সৃষ্টি হবে তা সনদ হিসেবে থাকবে। যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসবে সেই সনদ বাস্তবায়নের জন্য তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। ডিসেম্বরের মধ্যে যদি নির্বাচন না হয় তাহলে দেশে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামাজিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে এবং সেটা তখন নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন হবে।
নির্বাচনের সময়সীমা বা রোডম্যাপ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে শোরগোলের মধ্যেই জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। এক. সংস্কার: এই সংস্কারের জন্য জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব ৪১ দফা সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে, দুই. ফ্যাসিস্টদের বিচার যা এমনভাবে হওয়া উচিত, যাতে ফ্যাসিস্টদের বিচার প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় এবং তিন. সঠিক নির্বাচন পদ্ধতি, নির্বাচনকে এমনভাবে পরিচালনা করতে হবে, যাতে কেউ সহজে প্রক্রিয়াটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, গত সাড়ে ১৫ বছরে এদেশের জনগণের ওপর জুলুম আর নির্যাতন করে যারা ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিল আগামী নির্বাচনের আগেই তাদের বিচারকাজ সম্পন্ন করতে হবে।
গত ১৬ই এপ্রিল গুলশানে মার্কিন ডেপুটি হেড অব মিশনের বাসভবনে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন বিচার, সংস্কার এবং গণপরিষদ নির্বাচন- আমাদের এই তিনটি দাবির কথা আমরা তাদেরকে বলেছি। আমরা এই তিনটি এজেন্ডা নিয়ে সারা দেশে কাজ করছি। বর্তমান মাঠ প্রশাসন নিরপেক্ষ আচরণ করছে না। বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চলছে। সেখানে প্রশাসন নিশ্চুপ ভূমিকা রাখছে। প্রশাসন প্রধান দল বিএনপি’র পক্ষ অবলম্বন করছে। এই ধরনের প্রশাসন থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন, আমলাতন্ত্র এবং পুলিশ আমাদের ঠিক করতে হবে। ন্যূনতম সংস্কার নয়, মৌলিক সংস্কার এবং রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তনের জন্য এনসিপি কাজ করছে। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে এমন কৌশলী বক্তব্য বিবৃতির মাঝেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত ১০ই এপ্রিল সুনামগঞ্জ সফরে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ওই রাস্তা থেকে আমারে বলতেছিল, আপনারা আরও পাঁচ বছর থাকেন’। তার এই বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোরগোল শুরু হলে তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন এইভাবে, জনগণ এই সরকারকে ৫ বছর দেখতে চায় এমন বক্তব্য তিনি দেননি। এটা তার কথা না, জনগণের কথা। গত ২৯শে মার্চ জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলমের নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন স্টেটসম্যানকে পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশের একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার আজীবন থাকবে।
বিএনপি’র দাবি চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন, সরকার বলছেন ২০২৬-এর জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে, বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের বক্তব্য দৃশ্যমান সংস্কার ও বিচারের পরই নির্বাচন। এই তিন ধরনের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে জনমনে নির্বাচন নিয়ে একধরনের সংশয় তৈরি হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে দুই-একজন উপদেষ্টার বক্তব্য যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
বাস্তবতা হচ্ছে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, স্বৈরাচার- ফ্যাসিস্ট ও তার দোসরদের বিচার এবং ফ্যাসিবাদের তত্ত্বাবধানে গত ১৬ বছরে তৈরি হওয়া প্রশাসনে শতভাগ নিরপেক্ষ হিসেবে গড়ে তুলে সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা যে সময়সাপেক্ষ ব্যাপার তা যে কেউ উপলব্ধি করতে সক্ষম। অর্থাৎ বিষয়টিকে অনেকটা প্রচলিত প্রবাদের ‘নয় মণ ঘি এবং রাধার নাচে’র সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে বৈঠকে নতুন এক বাংলাদেশের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে বলেছেন, বাংলাদেশে যেন ফ্যাসিবাদী শাসন ফেরত না আসে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্থায়ী রূপ নেয় এবং যেন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং সমস্ত নিপীড়ন মোকাবিলা করতে পারি। সেই ব্যবস্থাগুলোকে অপসারণ করতে পারি।
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর আপামর দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল পতিত স্বৈরাচার এবং তার দোসরদের দ্বারা সংঘটিত গুম, খুন, নির্যাতন, লুটপাট, বিদেশে অর্থ পাচার, গণতন্ত্র ধ্বংস, প্রশাসনের দলীয়করণ ও অপরাপর অপরাধের বিচার এবং একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংস্কারের মাধ্যমে নির্বচনী ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা সর্বোপরি যথাসম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া। কিন্তু ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়েও একধরনের ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে ভোটের আয়োজন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে দ্রুত সময়ের মধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত, নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ ও নির্বাচনী আইনগুলোও সংস্কার করতে হবে। নির্বাচনে পর্যবেক্ষক নিবন্ধন এবং প্রয়োজনীয় কেনাকাটার মতো কাজগুলো শেষ করতে হবে। কিন্তু সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব চূড়ান্ত না হলে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধন না করে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া দুরূহ হয়ে উঠবে। তাছাড়া ডিসেম্বর- জানুয়ারির পর জুন পর্যন্ত প্রকৃতি এবং পরিবেশ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কতোটা সহায়ক সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষা। মাহে রমজান ও ঈদুল ফিতর। মে মাসে ঈদুল আজহা। এ সময় বর্ষা মৌসুম। এইচএসসি পরীক্ষা জুলাই-আগস্টে। সবকিছু মিলিয়ে আগামী জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনেকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে বিচার বিশ্লেষণ করছেন।
বাস্তবতা হচ্ছে দেশবাসী একটি কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। দীর্ঘ ১৬ বছর জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দিতে না পেরে মানুষ ভোট দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। এই দেশের মানুষ নির্বাচনকে উৎসব হিসেবে উদ্যাপন করতে অভ্যস্ত। অতীতের ১০টি হোন্ডা ২০টা গুণ্ডা মার্কা নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনামলের বিনা ভোট, রাতের ভোট ও ডামি নির্বাচনে মানুষ শুধু সংবিধান স্বীকৃত নাগরিক অধিকার ভোটাধিকার থেকেই বঞ্চিত হয়নি, দেশের অধিকাংশ নাগরিককে ওই তিনটি নির্বাচনের সময়ে ভয়, আতঙ্ক, নির্যাতন, গুম, খুন, গায়েবি মামলা, জেল-জুলুমের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এমনকি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীরা পর্যন্ত তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের তাঁবেদার প্রশাসনের দ্বারা শারীরিক নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি। সঙ্গত কারণেই বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যারা বিগত দিনে দেশের সংবিধান, আইনকানুন এমনকি ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধকে পদদলিত করে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার কবর রচনা করেছে, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে আয়নাঘরে বন্দি করে রেখেছিল! প্রশাসনকে ক্ষমতাসীন দলের সেবাদাসে পরিণত করে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল! যে-ই শক্তি অন্যায় ভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জুলাই-আগস্টে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে ২০ হাজারের বেশি মানুষকে আহত করে গণরোষের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছে। শাসনের নামে লুটপাট করে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য একটি বিশেষ দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে দেশকে তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। যে-ই দল যখনই রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে রক্তের হোলি খেলেছে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকাকালে সরকারি সম্পদ চুরি, বিপ্লবী নেতা সিরাজ সিকদারসহ ২২ মতান্তরে ৩৫ হাজার ভিন্নমতাবলম্বীদেরকে হত্যা করেছে, যে-ই দল ২০০৯ সলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে অতীতের পুনরাবৃত্তি করেছে এবং আগামীতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে পুনরায় একই পথে হাঁটবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই, সেই দল বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা- এই প্রশ্নের মীমাংসা জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইনক্লুসিভ নির্বাচনের নামে সেই দলকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়ে পুনরায় ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পুনর্বাসন নিশ্চিত করা হবে কিনা? যদি তা না হয় তবে জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে অতি অবশ্যই এই দলটির বিষয়ে জাতিকে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। অন্যথায় দেশবাসীর মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক থেকে যাবে। যদি কোনো কারণে দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারে তবে ৫ কিংবা ১০ বছর পরেও রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে আসে তবে প্রতিশোধস্পৃহা লালনকারী শেখ হাসিনা এবং তার দোসররা দেশের ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হবে। ইতিমধ্যেই পলাতক শেখ হাসিনা এবং তার দোসররা অডিও- ভিডিও মারফত বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে হুমকি-ধামকি প্রদান করছে আওয়ামী বিরোধীদের নামের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য। সুযোগ পেলে বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে। হাত-পা ভেঙে দিতে। পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এসে বিচারের নামে গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িতদের বিচার করবে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দল হিসেবে বিগত ১৬ বছরের শাসনামলে লুটপাট, গুম, খুন, গায়েবি মামলা, আয়নাঘরে বন্দি নির্যাতন সর্বশেষ জুলাই ম্যাসাকার নিয়ে দলের কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কোনো অনুতাপ- অনুশোচনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরঞ্চ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পলাতক থেকেও তাদের নেত্রীর পক্ষাবলম্বন করে হুংকার দিচ্ছেন। তাদের হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠছে। কাজেই দলগতভাবে সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার হওয়া অত্যাবশ্যক। অন্যথায় এর জন্য জাতিকে একদিন চরম মূল্য দিতে হতে পারে। তাছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের পুলিশ বাহিনী কর্তৃক নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কতোটা সম্ভব হবে বাস্তবতার নিরিখেই সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সরকার এবং রাষ্ট্রের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। সত্যিকারের দেশপ্রেমিক জনপ্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা তুলে দিতে মুখিয়ে আছেন। কাজেই আমরা আশা করবো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অপরিহার্য সংস্কার সম্পন্ন করে যথাসম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা। ্ত
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট