সা ফ ক থা

আইনশৃঙ্খলায় আমলে নিন সতর্কবাণী

হাসান মামুন | মতামত
মার্চ ১, ২০২৫
আইনশৃঙ্খলায় আমলে নিন সতর্কবাণী

একটা নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা ছিল বৈকি। এও ঠিক, এমন গণ-অভ্যুত্থান অভিজ্ঞতার মধ্যে নেই বলে আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আইনশৃঙ্খলার কতোটা আর কী ধরনের অবনতি হতে পারে। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আশা করা গিয়েছিল, ধীরে হলেও আইনশৃঙ্খলায় উন্নতির একটা ধারা আমরা দেখতে পাবো। সেটা হলে এর প্রভাব বিশেষ করে স্থবির অর্থনীতিতে পড়বে। এরকম আশাবাদও জন্মেছিল। কিন্তু ইউনূস সরকারের ছয় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হচ্ছে না; বরং অবনতি ঘটছে নতুন করে। 


আমরা জানি, কোন্‌ পরিপ্রেক্ষিতে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামের বিশেষ অভিযান শুরু করা হয়েছে। তার আগে থেকেই কিন্তু মাঠে থাকা সেনাবাহিনীকে দিয়ে রাখা হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা। এরই মধ্যে বিশেষ অভিযান শুরু করায় প্রত্যাশা জন্মে, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবাই আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে বিশেষভাবে উদ্যোগী হবে এবার। ব্যবসায়ীদের তরফ থেকেও কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পর থেকেই বলা হচ্ছিল, তারা যেসব সমস্যা মোকাবিলা করছে- তার মধ্যে প্রধান হলো নিরাপত্তাহীনতা। এটা কেবল শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ ঘিরে নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ায়। এর মধ্যে রপ্তানিতে অবশ্য ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি রয়েছে। আর প্রবাসীদের পাঠানো অর্থকড়িও বাড়ছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এটা রিজার্ভের উন্নতিতে রাখছে বিশেষ অবদান। এও ঠিক, সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনুকূলে না এলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে না। এমনিতেও কোনো অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নতুন বিনিয়োগ হওয়ার কথা নয়। বিনিয়োগকারীরা স্বভাবতই অপেক্ষা করে থাকে সুনির্দিষ্ট মেয়াদের সরকারের জন্য। এমন সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে আসে বলে তার গৃহীত নীতি-কৌশলে বিনিয়োগকারীদের ভরসাও থাকে। তা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা গেলে পুরনো বিনিয়োগে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় চালাতে পারতো কাজ। সেক্ষেত্রে সুখবর মিলছে না। এদিকে ব্যবসায়ীদের হয়তো আগের মতো ঘুষ দিতে হচ্ছে না সরকারি দপ্তরে; কিন্তু তারা যে ‘রাজনৈতিক চাঁদাবাজি’ থেকে এখনো মুক্ত নয়, সেটা খোদ অর্থ উপদেষ্টা একাধিকবার বলেছেন। পণ্যবাজার স্বাভাবিক না হওয়ার পেছনেও রয়েছে চাঁদাবাজি। 


ফুটপাতের দোকানদারদের সঙ্গে কথা বললেও বোঝা যায়, হালে পুলিশের চাঁদাবাজি বন্ধ হলেও রাজনৈতিক চাঁদাবাজি অব্যাহত এবং এক্ষেত্রে হয়েছে কেবল ‘হাতবদল’। বড় একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে এক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হলেও তাতে এসব অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না। চাঁদার দাবিতে হাটবাজারে গিয়ে ভাঙচুর চালানোর দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে ফেসবুকে। এতে এক সুবিধা অবশ্য হয়েছে প্রায় সব অনাচারের ভিডিওচিত্র ধারিত থাকছে সেলফোনে। তার কিছু হয়ে যাচ্ছে ‘ভাইরাল’। ছিনতাই ও খুনের কিছু ঘটনা এভাবে ভাইরাল হয়ে মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। অধিকাংশ ঘটনার পর অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সমর্থ হলেও ওইসব ঘিরে আতঙ্ক কিন্তু কমছে না। গণ-অভ্যুত্থানের পরাজিত পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলার অবনতির ওপর বানোয়াট প্রচারণাও চলছে। তারা দেখাতে চাচ্ছে, ড. ইউনূস সরকার সুশাসনের অঙ্গীকার নিয়ে এলেও সুষ্ঠুভাবে দেশ চালাতে পারছে না। এমন প্রচারণায় লোকে যে একেবারে প্রভাবিত হচ্ছে না, তা নয়। অনেককে শুধু আইনশৃঙ্খলার অবনতি দেখেই বলতে শোনা যাচ্ছে- ‘আগেই ভালো ছিলাম’! পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটানো গেলে তারা যে পরিবর্তনে আস্থা ফিরে পাবে না, তাও নয়। মানুষ স্বভাবতই চায় স্বস্তি এবং আইনশৃঙ্খলার উন্নতির ভেতর দিয়ে তার অনেকখানিই অর্জিত হতে পারে। 


আইনশৃঙ্খলার অবনতির একটা বড় প্রমাণ বিশেষত রাতের বেলায় জননিরাপত্তা ভেঙে পড়া। দেশ জুড়ে সড়কপথে ডাকাতি বেড়েছে অনেক। একটি ঘটনায় যাত্রীবাহী বাস আটকে সর্বস্ব লুট এবং নারী ধর্ষিত হওয়ার মতো অভিযোগ সামনে এসেছে। ধর্ষণ ঘটেছে কী ঘটেনি, তা নিয়ে হয়তো বিতর্ক আছে; কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক তীব্র হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। রাতের ভ্রমণে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেই ধারণা। রাতে পণ্য পরিবহনও হয়ে থাকে ব্যাপকভাবে। ডাকাতি নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিতদের স্বস্তিও উবে যাবে। ঈদের বাজারে অর্থকড়ি নিয়ে চলাচলও এ অবস্থায় ব্যাহত হতে পারে এবং এসবের প্রভাব পড়তে পারে পণ্যবাজারে। নিত্যপণ্যের আমদানি পরিস্থিতি ভালো করলেই চলবে না। অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের চলাচলও স্বাভাবিক রাখতে হবে। 


গভীর রাতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সংবাদ সম্মেলন ডাকার পর কিছু বিশেষ উদ্যোগ অবশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষত বাড়ানো হয়েছে টহল। এ কার্যক্রম অলিগলিতেও জোরদার করতে কিছু মোটরসাইকেল নাকি কেনা হবে। গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার সময় তাদের অনেক যানবাহনও বিনষ্ট হয়। পুলিশ স্টেশন থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ হয় লুট। তার অংশবিশেষ কেবল উদ্ধার হয়েছে। বাকি অস্ত্র আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা, কে জানে। অপরাধীরা অবশ্য বেশি ব্যবহার করে ক্ষুদ্রাস্ত্র। এসব কালোবাজার থেকেই তারা সংগ্রহ করে আসছে। যেকোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে, যেমন নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালানো হয়ে থাকে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে জরুরি সংস্কার সেরে জাতীয় নির্বাচনের দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ অবস্থায় লুণ্ঠিত অস্ত্র তো বটেই; অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানও জোরদার করা প্রয়োজন। কিন্তু কে করবে জোরদার? 


ড. ইউনূস সরকার ছয় মাসেও হাসিনা সরকারের একান্ত অনুগত পুলিশকে ঢেলে সাজাতে পারেনি। তার মনোবল ফিরিয়ে আনাও হয়নি সম্ভব। তবে পুলিশের নিরাপত্তায় সেনা মোতায়েন করে রাখার মতো পরিস্থিতির অবসান হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশে এখনো চলছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্তও চলমান। এ প্রক্রিয়াটি দ্রুত সম্পন্ন করে বলে দিতে পারলে ভালো হতো। বাকিরা এখন নিশ্চিন্তে বিধিবদ্ধ কাজ করুন। সেটি এখনো বাস্তবতা নয় বলে পুলিশে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। পুলিশসহ প্রায় সব বাহিনীতে এজন্য ‘প্যানিক’ বা ভয়ভীতি কাজ করছে। এ কথাটা হালে সেনাপ্রধান জোর দিয়ে বলেছেন। অপরাধের বিচার হবে অবশ্যই; কিন্তু সে কারণে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো যেন অকার্যকর হয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতিতে ঢুকে না যায়। সেদিকে সরকারের সুনজর থাকা প্রয়োজন বলেই তিনি মনে করেন। 


জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে আন্দোলন দমনে বিশেষভাবে ব্যবহৃত র‌্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ থাকলেও সরকার চাইছে এর নাম ও পোশাক বদলাতে। প্রয়োজনে পুনর্গঠন। কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করে তার অপরাধী অংশটিকে কেবল বিচারের মুখোমুখি করা হবে- এমন আলোচনাও লক্ষণীয়। পুলিশসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ক্ষেত্রেও একই অবস্থান সরকারের। তা সত্ত্বেও কতোদিনে বিশেষত পুলিশকে পুরোপুরি সক্রিয় করে তোলা যাবে, সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না। পুলিশের দায়িত্ব সেনাবাহিনী যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম, এমনটিও নয়। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ তো দেয়া হয়নি সেনাবাহিনীকে। তাদের কাজ দেশরক্ষা এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা জোগানো। তবে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে দীর্ঘ সময় তাদের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরাসরি কাজ করতে হচ্ছে। এত দীর্ঘ সময় ব্যারাকের বাইরে থাকতে না চাইলেও ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ বলে কথা। সেনাসদস্যদের আবার বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে, যাতে অপ্রীতিকর বিতর্কে জড়াতে না হয়। এদিকে বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর দৃষ্টি রয়েছে উন্নত মানবাধিকারে বিশ্বাসী পশ্চিমা দুনিয়ার। শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের নেতৃত্বে আছেন বলেও তাদের প্রত্যাশা বেশি। তবে এ সরকারের আমলে শুরু থেকে শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে যে মব ভায়োলেন্স চলছে, সেগুলো তার ভাবমূর্তির জন্য মোটেও ভালো হচ্ছে না। বাংলাদেশে সূচিত পরিবর্তনের ধারার ওপর যথেষ্ট আস্থাও জন্মাচ্ছে না পশ্চিমাদের। এখানে ‘উগ্রবাদী তৎপরতা’ বাড়ছে বলেই বরং তাদের মনে বিশ্বাস ক্রমে জোরদার। দেশের প্রতিষ্ঠিত কিছু মিডিয়াকেও চাপে ফেলেছে মব। গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী কোনো কোনো পক্ষের ভেতর থেকেই ঘটছে এসব। সেনাপ্রধান এটা পরিষ্কার করেই বলেছেন, নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটির সুযোগে অপরাধীরা তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব অব্যাহত থাকলে ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব’ বিপন্ন হতে পারে বলেও সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন তিনি। 


আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য কেবল পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের দায়ী করার প্রবণতা আদতে ‘নিজেদের’ ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা কিনা, সেই প্রশ্ন এখন স্বভাবতই বেশি করে উঠবে। আইনশৃঙ্খলার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন ঘটনায় ‘প্রতিক্রিয়া’ জানাতেও দেরি করে ফেলেছে সরকার। ব্যবস্থা গ্রহণ তো পরে। তাতে এমন প্রচারণা চালানোর সুযোগও বেড়েছে যে, তারা নিরুপায় কিংবা উদাসীন! গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে দায়িত্বগ্রহণকারী কোনো সরকারের ব্যাপারে এমন ধারণা সৃষ্টি হওয়া মোটেও ইতিবাচক নয়। এর ভেতর দিয়ে তার ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’ সংক্রান্ত ধারণাটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কাও উপস্থিত হয়। দানা বাঁধে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। যে সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের ওপর অতিশয় জোর দিচ্ছে এবং এর মধ্যে পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো সুশাসন সম্পর্কিত এজেন্ডাও রয়েছে, সেই সরকারের সদিচ্ছার বিষয়ে জনমনে সুস্পষ্ট ইতিবাচক ধারণা থাকা বরং জরুরি। 


এখন যেভাবেই হোক, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটিয়ে মানুষের মনে নিরাপত্তাবোধ জাগিয়ে তুলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে যেতে হবে সরকারকে। জাতীয় নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা এক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে। তাতে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত পক্ষগুলো উপযুক্ত বার্তা পাবে। জনপ্রশাসনও কাজ করতে পারবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে। ক্রান্তিকালে বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ সেনাবাহিনীও তখন ব্যারাকে ফেরার নির্ভরযোগ্য পরিকল্পনা করতে পারবে। এর মধ্যে পুলিশের যতটা সম্ভব সংস্কার করতে হবে সম্পন্ন। ক্ষমতাচ্যুতদের অপরাধী অংশের বিচার কার্যক্রমও চালিয়ে যেতে হবে। তাদের নিরপরাধ অংশটি দোষ-ত্রুটি স্বীকার করে নির্বাচনে অংশ নিতে পারলে ওই পক্ষ থেকে প্রত্যাঘাত চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহও কমে আসবে। 


লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মতামত'র অন্যান্য খবর