বাংলাদেশে দুটি গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। দুটো গণ-অভ্যুত্থানেই সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থন ছিল। প্রথমটি ১৯৯০ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে। এরশাদ যখন দেখলেন, তার ক্ষমতায় থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই, তিনি তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) নূরউদ্দিন খানকে দিয়ে সেনাশাসন জারি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেনাপ্রধান রাজি হননি। এতে এরশাদের পৌনে নয় বছরের শাসনের সমাপ্তি ঘটে।
দ্বিতীয় গণ-অভ্যুত্থান ঘটে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার একটানা সাড়ে পনের বছরের শাসনের অবসান ঘটে। শেখ হাসিনাও চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে আন্দোলন দমন করতে। কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান রাজি হননি। এর আগে ৩রা আগস্ট তিনি যে ফরমেশন কমান্ডারদের বৈঠক ডেকেছিলেন, তাতে প্রায় সবাই বলেছিলেন, তারা আন্দোলনকারী জনগণের বিপক্ষে যাবেন না।
এরপরই ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, এটি ছিল সামরিক-বেসামরিক যৌথ উদ্যোগ। আন্দোলনকারীদের অভিপ্রায় অনুযায়ী ৮ই আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, তার অনুঘটক ছিলেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ- জামান। তিনি আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সেনানিবাসে ডেকে নিয়ে পরিস্থিতি উত্তরণে উপায় খুঁজে বের করতে বলেন।
সে সময়ে সেনাশাসন প্রতিষ্ঠারও গুঞ্জন ছিল। কিন্তু সেনাপ্রধান জানিয়ে দিলেন, তাদের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। তারা ক্ষমতা দখল করবেন না, বরং বেসামরিক সরকারকে সমর্থন করবেন।
তিনিই প্রথম অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে ধারণা দেন রয়টার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে। বলেছিলেন, ‘১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়া সম্ভব। নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনী ড. ইউনূস সরকারকে সমর্থন করে যাবে।’ সেই সমর্থন এখনো অব্যাহত আছে।
এরই মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা সাধারণ মানুষকে উদ্বিগ্ন ও বিচলিত করে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশৃঙ্খলা। ৫ই আগস্টের পর সরকারের প্রতি যেই জনসমর্থন ছিল, সেটা আর এখন নেই। প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো জনগোষ্ঠী দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে নামছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের বিবদমান পক্ষগুলো সংঘাত সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাকযুদ্ধ চলছে। পুলিশ ও জনপ্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাও চোখে পড়ার মতো।
এই প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শাহাদতবরণকারী সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় নীতি ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, যারা অপরাধ করেছেন, তাদের বিচার হোক কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানকে হেয় করা যাবে না।
তার ভাষায়, ‘পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই-এগুলো দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে অতীতে। খারাপ কাজের সঙ্গে অসংখ্য ভালো কাজ করেছে। আজকে যে দেশের স্থিতিশীলতা, দেশটাকে যে এত বছর স্থিতিশীল রাখা হয়েছে, এটার কারণ হচ্ছে এই সশস্ত্র বাহিনীর বহু সেনাসদস্য, সিভিলিয়ান-সবাই মিলে এই অর্গানাইজেশনগুলোকে, অসামরিক-সামরিক সবাই মিলে এই অর্গানাইজেশনগুলোকে ইফেক্টিভ (কার্যকর) রেখেছে।’
কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাজের সমালোচনা এক কথা আর সামাজিকভাবে কাউকে অপদস্থ অপমান করা এক কথা নয়। সামপ্রতিককালে দেশের বাইরে থেকে কিছু ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুক, ইউটিউবে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। তারা মুক্তমনা সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করছেন, রাজনীতিকদের আক্রমণ করছেন। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানকেও আক্রমণ করছেন। এখানে ব্যক্তির বিষয় নয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির বিষয়। তাদের বক্তব্য-বিবৃতি দেখলে, শুনলে মনে হবে বাংলাদেশে অবিরাম ‘যুদ্ধ’ চলছে। তারা কাউকে পদ থেকে নামাচ্ছেন, কাউকে বসাচ্ছেন। কোনো প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় হামলা করার আগাম ঘোষণা দিচ্ছেন। কিন্তু সরকার সবকিছুতে চোখ বুজে আছে। আইন এখানে অনেকটা অন্ধ। এই অবস্থায় কোনো দেশে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি আশা করা যায় না।
রাষ্ট্রীয় বাহিনী সম্পর্কে সেনাপ্রধানের স্পষ্ট বক্তব্য, ‘আজকে পুলিশ সদস্য কাজ করছে না। একটা বড় কারণ হচ্ছে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা। অনেকে জেলে। র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই প্যানিকড (আতঙ্কিত)। বিভিন্ন দোষারোপ, গুম-খুন ইত্যাদির তদন্ত চলছে। অবশ্যই তদন্ত হবে। দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এমনভাবে কাজটা করতে হবে, যেন এই অর্গানাইজেশনগুলো আন্ডারমাইন না হয়।
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সতর্কবাণী ‘আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন, এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমি আজকে বলে দিলাম নইলে আপনারা বলবেন যে, আমি আপনাদের সতর্ক করিনি। আমি সতর্ক করে দিচ্ছি আপনাদের।’
সেনাপ্রধানের এই সতর্কবাণীর লক্ষ্য কেবল সেনাসদস্য ও সাবেক সেনাসদস্য নন। এর লক্ষ্য সমাজের সামরিক- বেসামরিক অংশীজন। এর মধ্যে সরকার আছে, রাজনীতিক আছেন, ছাত্রনেতৃত্ব আছে। নাগরিক সমাজ আছে। ৫ই আগস্টের পর এদের মধ্যে একটি চমৎকার সম্পর্ক ও বোঝাপড়া ছিল। কিন্তু সাড়ে ছয় মাসের মাথায় এসে দেখা গেল সেই সম্পর্ক ও বোঝাপড়া নেই। একপক্ষ অন্যপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। নিজেকে একমাত্র দেশপ্রেমিক হিসেবে জাতির সামনে তুলে ধরছে। কারও সঙ্গে মতের অমিল হলেই তাকেই স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন। রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় ঐক্যের কথা বলছে। তারপরও সেই ঐক্যের বদলে বিভেদই প্রশস্ত হচ্ছে কেন? হানাহানি ও সংঘাত বাড়ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। এই সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনীতি ভালো হলে যেমন তারা কৃতিত্ব নিতেন, তেমনি ভালো না হওয়ার দায়ও তারা অস্বীকার করতে পারবেন না। সরকার জনগণের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানে সরকার কাজ করছে সেটা দৃশ্যমান নয় অনেক ক্ষেত্রেই। আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে সরকার অপারেশন ডেভিল হান্ট কর্মসূচি নিয়েছে। প্রতিদিন শত শত মানুষকে ধরা হচ্ছে। অন্যদিকে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ও ডাকাতির সংখ্যাও বাড়ছে। আজ ঢাকাসহ সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যৌথ বাহিনীর টহলের মাঝেই একের পর এক অপরাধের ঘটনা ঘটছে। টাঙ্গাইলে শিক্ষা সফরে যাওয়া চারটি বাসও ডাকাতের কবলে পড়েছে। এ থেকে মুক্তির উপায় কি?
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। সরকার ঘটনা তদন্তে একটি কমিশন গঠন করেছে। নিহত সেনা কর্মকর্তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ২৫শে ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় সেনা শোক দিবস ঘোষণা করেছে। এটা নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবার কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পাবে। অন্যদিকে হত্যাকাণ্ডের দায়ে যেসব বিডিআর সদস্য দণ্ডিত হয়েছেন, তাদের পরিবারের দাবি, সাবেক সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাদের জড়িয়েছে। তারা এর প্রতিবাদও করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা রকম মন্তব্য আসছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, সাবেক বিডিআরের সদস্যরাই সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করেছেন- এর মধ্যে ‘ইফ’ ও ‘বাট’ নেই। যারা পিলখানা হত্যাকাণ্ডের দায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিবেশী একটি দেশের ওপর চাপিয়ে বিডিআর সদস্যদের রেহাই দিতে চাইছেন, সেনাপ্রধানের বক্তব্য তাদের সঙ্গে কোনোভাবে মিলছে না। তিনি অপরাধীদের শাস্তি পেতে হবে বলে জানিয়েছেন।
সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে আমাদের রাজনীতিকেরা কীভাবে নেবেন? কীভাবে নেবেন আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী ছাত্রনেতৃত্ব কিংবা অন্তর্বর্তী সরকার? তিনি সবার প্রতি ‘বার্তা’ দিয়েছেন। তার এই বার্তা সীমারেখা লঙ্ঘিত হয়েছে কিনা, সেই প্রশ্ন উঠতে পারে। আবার সেনাপ্রধান যেই প্রশ্ন তুলেছেন, সেটাও ফেলে দেয়ার মতো নয়। তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে সহায়তা করে আসছে। পর্যায়ক্রমে ৩০ হাজার সেনা যৌথ বাহিনীর হয়ে মাঠে কাজ করছে, তারপরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন হচ্ছে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো দল আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে একটি পত্রিকার কাছে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করেছেন কয়েকজন রাজনীতিক। এর মধ্যে আছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু, ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী ও বাংলাদেশ এলডিপি’র মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম। তারা নির্বাচনের বিষয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন কিন্তু এর ভেতরের ‘গূঢ় রহস্য’ উন্মোচনের চেষ্টা করেননি। আমাদের রাজনীতিকরা দূরের নয়, কাছের ‘বস্তু’ দেখতেই অভ্যস্ত।