এই তো সেদিন এম্বুলেন্সযোগে গুরুতর অসুস্থ বাবাকে নিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকার মহাখালীর একটি হাসপাতালে যাই। ফেরার পথে তিতুমীর কলেজের সামনে ওই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার আন্দোলনে বাধাপ্রাপ্ত হই। শত শত গাড়ি আর পথচারীর ভোগান্তিতে ত্রাহি অবস্থা। এই দৃশ্য শুধু মহাখালীর নয়, সমস্ত ঢাকা শহরেই বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পূরণের জন্য একের পর এক চলছে আন্দোলন। ধরে নেয়া হয়েছে আন্দোলন করে যেহেতু সরকারকে বিতাড়িত করা যায়, তাহলে যৌক্তিক হোক বা অযৌক্তিক হোক আন্দোলনের মাধ্যমে বিদ্যালয়কে মহাবিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় করার চেষ্টা করলে দোষ কোথায়? এ বিষয়ে বিস্তারিত বলবো নিবন্ধের শেষদিকে। তার আগে ৫ই আগস্ট পরবর্তী কয়েকটি আন্দোলন, নেপথ্যে কারণ এবং ফলাফল নিয়ে বোধ করি একটু কথা বলা প্রয়োজন। ড. ইউনূস সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত শুধু ঢাকাতেই দেড় শতাধিক আন্দোলন হয়েছে বলে খবর প্রকাশ করে বিভিন্ন গণমাধ্যম। এখনো চলছে দাবি-দাওয়া পূরণের জন্য বিভিন্ন মহলের আন্দোলন।
জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ে স্থগিত করা এইচএসসি পরীক্ষা না দিয়ে অটোপাসের আন্দোলনের মাধ্যমে ছিল এর অভিষেক। ১৯শে আগস্ট এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের করা আন্দোলনে অবাক করা বিষয় হলো পরীক্ষা নেয়া-না নেয়ার সুফল-কুফল না ভেবেই আন্দোলনে সায় দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারে এমন কেউ ছিল না বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বুঝানোর। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ছিল আমাদের বাঁচার লড়াই। ওই সময়ের ’৭১ সালের এসএসসি পরীক্ষা যদি একবছর পর ১৯৭২ সালে নেয়া যায় তাহলে জুলাই বিপ্লবে ১ মাসের জন্য স্থগিত হওয়া পরীক্ষা কি দু’মাস পর নেয়া যেতো না? সচিবালয়ে অল্প কিছু ছাত্রের আন্দোলনে সরকার নত হয়েছে দেখে ২৫শে আগস্ট বিজিবি তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সচিবালয় অবরুদ্ধ করে। দেশে এই প্রথম এত সংখ্যক বিজিবি সদস্যকে একসঙ্গে দেখার কপাল হলো (যদিও ঘটনাটি ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুর্ভাগ্যজনক)। অন্যদিকে পরের দিন ২৬শে আগস্ট ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সচিবালয় ও রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনা ও তার আশপাশের এলাকায় জনসমাগম নিষিদ্ধ করলেও তা কি প্রকৃতপক্ষে কার্যকর হয়েছে? পদ-পদোন্নতির দাবিতে কলমবিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে খোদ সচিবালয়ের সচিবরা পর্যন্ত আন্দোলনে নামতে পিছপা হয়নি। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে যদি আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে তাহলে আর কী বাদ থাকে? গত মাসের শেষের দিকে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনরত ছিল দেশের এবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা। ঠিক একই সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দশম গ্রেড বেতন-স্কেল বাস্তবায়নের দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো এবতেদায়ি শিক্ষকদের লাঠিপেটা করে যেভাবে দমানো হলো অন্যান্য আন্দোলন দমনের ক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর হওয়া দূরের কথা, ‘টুঁ’-শব্দটি করতে দেখা যায়নি।
এবতেদায়ি শিক্ষকরা এই যুগে এসে হাজার দুয়েক টাকা বেতনে হাজার হাজার শিক্ষার্থী পড়াচ্ছেন। একই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ২০১৩ সালে রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলগুলোকে জাতীয়করণ করা হলেও অবহেলিত হয়ে আসছে স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদ্রাসা। কোনো সরকার কোনোকালে তাদের দিকে নজর দেয়নি। তাই তারা রাস্তায় নেমে আসে এবং মার খেয়ে ফিরে যায়। হ্যাঁ, সরকারের তরফ থেকে তারা আশ্বাস একটা পেয়েছে, কিন্তু ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকার তাদেরকে কতোটুকু আলোর মুখ দেখাবে তা সময়ই বলে দিবে। প্রশ্ন জাগে তাদের আন্দোলন যদি যৌক্তিক হয় তাহলে প্রজন্ম গড়ার কারিগর শিক্ষকদের লাঠিপেটা করা হলো কেন? তাদের সঙ্গে আরও আগে কথা বললে বিষয়টির সাময়িক সুরাহা করা যেত। তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকার বিভিন্ন সড়কের পাশাপাশি রেললাইনও তখন অবরোধ করেছে। সরকারের আশ্বাসে বিরতির পর আবারো সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছে তারা। বিচার-বিবেচনায় এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। দাবি যদি ন্যায্য হয় তাহলে তার পক্ষে থাকে সবাই, যেমনটি আমরা দেখছি ৫ই আগস্টের পূর্বে ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলনে। আর যদি দাবিটা হয় মামাবাড়ির আবদারের মতো তাহলে এর যৌক্তিকতা নিয়ে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন পড়ে। নিঃসন্দেহে তিতুমীর কলেজের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রয়েছে। ওদিকে র্যাংকিংয়ে জাতীয় পর্যায়ে সেরা কলেজের তালিকায় রাজশাহী কলেজ অনেক সময়েই থেকেছে শীর্ষে। প্রতিষ্ঠার বিচারে এই কলেজ তিতুমীরসহ অন্যান্য অনেক নামি কলেজ থেকে শতবর্ষ পুরনো। এর মানে এই নয় যে, তিতুমীর কলেজকে নয়, রাজশাহী কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে হবে আগে। কোনো এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবার আগে ভাবতে হবে এর উপযোগিতা কতোটুকু। দ্বিতীয়ত হলো এর ফিজিবিলিটি বা সাধ্যায়ত্ত অবস্থা। বিগত দেড় দশক ধরে কোনো গবেষণা-বিশ্লেষণ ছাড়াই বছরে বছরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ডজনের পর ডজন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেখভাল করার কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ৫৫টি সরকারি ও ১১৫টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারে নত।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাজুক অবস্থার কথা নাই বা বললাম, গত ১৫ বছরে জেলায় জেলায় যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তাদের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের না আছে উপযুক্ত অবকাঠামো, না আছে পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ শিক্ষক। প্রতিষ্ঠার অর্ধ যুগ পার হলেও ভাড়া করা বাড়িতে বা পাশের সরকারি কলেজ ভবন ব্যবহার করে চলছে এগুলোর পাঠদান কার্যক্রম। তার মানে হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বুঝায় সেই মানে উন্নীত করতে এখনো বহুদূর। এই মুহূর্তে কোনো কলেজকে বিচার-বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে চাপের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণা করা কতোটা ভালো হবে তা সন্দেহের অবকাশ রাখে।
ঢাকার ৭ কলেজকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়া হয় তখন না বুঝে আনন্দে মাতোয়ারা ছিল কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা। আমি তখনই ধারণা করেছিলাম সিদ্ধান্তটা দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনবে না। কারণ এক সময় দেশের কলেজগুলোর অনার্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রামের তদারকি করতো পুরনো তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। তখন মেডিকেল কলেজগুলোরও দায়িত্ব ন্যস্ত হয় এগুলোর উপর। কালের বিবর্তনে যখন কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় তখন ওই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোর অতিরিক্ত চাপ এড়ানোর জন্য সরকারকে একটি এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাগিদ দেয় এবং যার ফলশ্রুতিতেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবির্ভাব হয়। তাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো কলেজকে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়া যেমন বিচক্ষণতার কাজ হয়নি তেমনি আবারো একটি অদূরদর্শিতার কাজ হবে এই ৭ কলেজকে যদি নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেয়া হয়। কারণ এই ৭ কলেজের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় বানালে দেশের বাকি নামিদামি কলেজের শিক্ষার্থীরা তো বসে থাকবে না। বরং বের করতে হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাটা কোথায়? দুই/একটি সমস্যা আমরা দূর থেকে সহজেই আঁচ করতে পারি। যেমন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে নিয়মিত ক্লাস না নিয়ে পরীক্ষা নেয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ক্লাসরুম ও শিক্ষক সংকট তো লেগেই আছে। জেলা-উপজেলায়, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে কখনো কখনো রাজনৈতিক চাপে বাধ্য হয়ে অনার্স-মাস্টার্স প্রোগ্রাম খোলার অনুমতি দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ অনেক আগে থেকেই। উচ্চশিক্ষার মানের দিকে খেয়াল না করে খেয়াল রাখা হয়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যার উপর। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থী সংখ্যা নিঃসন্দেহে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা মিলিয়ে যা হবে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। সঙ্গত কারণেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক তহবিল অন্যান্যগুলোর চেয়ে অনেক সচ্ছল হওয়ার কথা। শোনা যায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাভাবে গবেষণায় মনোযোগ দিতে পারছে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থের অভাব না থাকলে গবেষণার জন্য এর অধীনে কলেজগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে তার খবর কি সরকার রাখে? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে ক্ষতি করা হয়েছে অনার্স প্রোগ্রামে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে (যদিও এবার নেয়ার ঘোষণা এসেছে)। কলেজের নাম পরিবর্তন করে বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করলেই শিক্ষার মানে উন্নতি হয় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর অনার্স-মাস্টার্স প্রোগ্রামে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন করতে হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে মাস্টার প্ল্যান নিতে হবে।
ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কিন্তু তার অধীনে অনেকগুলো কলেজের মাধ্যমে সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে, আর আমাদের দেশের কলেজগুলো সক্ষমতা অর্জন করতেই হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে বাহবা নেয়ার চাইতে মানোন্নয়নে আগে নজর দেয়া দরকার। রাস্তা অবরোধ করে কর্মসূচি দিয়ে জনসাধারণকে জিম্মি করে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর দাবি পৃথিবীর আর কোনো দেশে হয়েছে বলে জানা নেই। মানুষের দুর্ভোগের উপর ভর করে কোনো দাবি আদায়ের আন্দোলনে জনরোষ বাড়ে বৈকি, কমে না।
বর্তমান সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য দেশের দিশাহারা সময়ে দায়িত্ব নিয়েছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে এই সরকারের। কাজে নিউট্রাল থাকলেই হবে না, জনদুর্ভোগ লাঘবে আন্দোলনকারী অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ বেছে নিতে সরকারের গতি নিউট্রাল গিয়ারে থাকবে না- এমনটাই প্রত্যাশা। ্ত
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ইংরেজি বিভাগ,
ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কিশোরগঞ্জ।