জাতিসংঘ তথ্যানুসন্ধান দলের যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, আমার ধারণা সেটি নিয়ে আগামীতে আরও বেশ কিছুদিন আলোচনা হবে। ১১৪ পৃষ্ঠার বিশাল এই প্রতিবেদনকে বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠী জনগণের সামনে উপস্থাপন করবে ‘অন্ধের হাতি দর্শন’- এর মতো করে। যার যা রাজনীতি, তার সঙ্গে মিলে যায় যতটুকু, সেটাই তারা উল্লেখ করবে বারংবার। ব্যক্তি হিসেবে, নাগরিক হিসেবে, আমারও কিছু অবজারভেশন আছে। কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। সেসব বিষয়ে সচেতন থেকেই দু’একটা কথা বলতে চাই।
প্রথম কথাটি বলবো শেখ হাসিনা সম্পর্কে। আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে, এমনকি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা অধ্যায়ের সম্ভবত সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনের কোথাও শেখ হাসিনা সম্পর্কে একটি ইতিবাচক শব্দও নেই। বরং সেখানে স্পষ্টভাবেই শেখ হাসিনাকে একজন নিষ্ঠুর ক্ষমতালোভী ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার কর্মকাণ্ডকে গণহত্যার সঙ্গেও তুলনা করা হয়েছে। সন্দেহ নেই, এমন একটি প্রতিবেদন হাসিনার ভক্তদেরকে দুঃখিত করবে, হতাশ করবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে উত্তেজিতও করবে। কিন্তু বাস্তবতাকে অস্বীকার তো করা যাবে না।
আমাদের দেশে তথ্য অনুসন্ধান বা তদন্ত প্রতিবেদন প্রায়ই হয়। কিন্তু সেসবের অধিকাংশই রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত থাকে। কখনো কখনো সরকার বা প্রশাসন যেভাবে চায়, সেভাবেই আসে রিপোর্ট। ফলে সেসব রিপোর্ট নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহও থাকে খুবই কম। প্রতিবেদন প্রকাশের পর, যাদের বিপক্ষে সেটি যায় তারা প্রত্যাখ্যান করে। বলে-যথাযথ তদন্ত করা হয়নি, রিপোর্ট সরকার কর্তৃক প্রভাবিত বা নির্দেশিত। কিন্তু এবার তো আর সেরকম কোনো অভিযোগ তোলা যাচ্ছে না। জাতিসংঘের এই অনুসন্ধানী দলের গায়ে বিএনপি বা জামায়াতের জামা পরানোর সুযোগও নেই। তারা প্রফেশনাল, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। এই প্রতিবেদনকে উপেক্ষা করবেন কীভাবে? আবার এই প্রতিবেদনকে যদি মানেন, তাহলে নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে মাথায় তুলেই বা রাখবেন কীভাবে?
ঠিক এই জায়গাটিতেই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আওয়ামী লীগকে। কোনো সন্দেহ নেই, গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা যেন সমার্থকে পরিণত হয়ে পড়েছিলেন। এই সময়ে আওয়ামী লীগেরও অনেক নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীকে আমি শেখ হাসিনার প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে দেখেছি। তারা বলতেন-হাসিনা ঠিকঠাক মতো দল চালাচ্ছেন না, এই আওয়ামী লীগ আর বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ নাই। হাসিনা সরকারের লুটপাট, কিংবা লুটপাটকারীদের প্রশ্রয় দেওয়া-এগুলো তাদেরকে হতাশ করতো, বিরক্ত করতো। কিন্তু শেষে আবার অসহায়ের মতো এমন কথাও বলতেন-বুঝি যে, এসব ভালো হচ্ছে না, কিন্তু কী করবো? এই বয়সে আর কোথায় যাবো? যেতেও তো পারবো না। তারা শেখ হাসিনাকে, হাসিনার রাষ্ট্র ও দল পরিচালনাকে অপছন্দ করতেন। কিন্তু অস্বীকার করতে পারতেন না, বিকল্প কিছু ভাবতে পারতেন না।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগে নিয়মিত কাউন্সিল হতো। প্রতিবারই শেখ হাসিনা সভাপতি নির্বাচিত হতেন। তিনি অবশ্য বলতেনও, যদি একজন কাউন্সিলরও তার বিরুদ্ধে ভোট দেয়, তাহলে তিনি এ পদে আর থাকবেন না। এমন আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণের আগে তিনি নিশ্চিতভাবেই জানতেন, কেউ তার বিরুদ্ধে ভোট দেবে না। এই যে কেউ তার বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার সাহস না করা, এমন পরিস্থিতিও তিনিই তৈরি করেছিলেন। দলের মধ্যেও তৈরি করে নিয়েছিলেন স্বৈরতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থা। তাই দলের যেকোনো কমিটি, কিংবা দলের কোনো সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের একক দায়িত্ব থাকতো তারই উপর। তিনি যা চাইতেন, তাই হতো। তার ইচ্ছামতো কমিটি হতো, কমিটি ভাঙতো। নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া বা না পাওয়া, সেসবও নির্ভর করতো তাকে খুশি করতে পারা বা না পারার ওপর। এভাবে শেখ হাসিনাই হয়ে উঠেছিলেন সরকার, হয়ে উঠেছিলেন আওয়ামী লীগ। তাই হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের কথা হয়তো ভাবতেই অস্বাভাবিক লাগবে। কিন্তু দলকে যে অবস্থায় নিয়ে গেছেন তিনি, বিষয়টা অস্বাভাবিক হলেও সেটাই সম্ভবত অনিবার্য নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশের আদালতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা এখন চলছে। হত্যা, গণহত্যাসহ সিরিয়াস টাইপের সব মামলা। এসব মামলা এমনকি আদালতকে পর্যন্ত রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে দিতে পারে আওয়ামী লীগের অন্ধ ভক্তরা। কিন্তু জাতিসংঘের প্রতিবেদনকে রাজনৈতিক বলবেন কোন যুক্তিতে? সেটা সহজ হবে না। এরই মধ্যে দেশের মানুষও বিষয়গুলো জেনে গেছে। ফলে মানুষকে উল্টাপাল্টা বোঝানো সহজ হবে না।
কিছু রাজনৈতিক দল এখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য বেশ উঠেপড়ে লেগেছে। গণহত্যার দায়ে তারা আওয়ামী লীগকে দল হিসাবেই নিষিদ্ধ করতে চায়। তারা চায় ছাত্রলীগকে যেভাবে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগকেও তেমনিভাবে নিষিদ্ধ করা হোক। এ নিয়ে তারা মিটিং, মিছিল করছে, বিবৃতি দিচ্ছে। কিন্তু ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে-জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনেও কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার বিরোধিতা করা হয়েছে। তারা বলেছে, কোনো রাজনৈতিক দলকেই নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না। সরকার নিজেও একাধিকবার বলেছে যে, তারা কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে চায় না।
এরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সুযোগ থাকবে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও মানতে হবে, যদি তারা আবার দেশের রাজনীতিতে ফিরতে চায়, সম্ভবত তাদেরকে হাসিনাকে বাদ দিয়েই চিন্তা করতে হবে। কেবল শেখ হাসিনাই নয়, সেই সঙ্গে চিন্তার বাইরে রাখতে হবে পুরো শেখ পরিবার, হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য, এমপি, এমপি প্রার্থী, কেন্দ্রীয় ও জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ, অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী, ইত্যাদি সকলকেই। সুস্থ রাজনীতিতে ফিরতে হলে তাদের নতুন নেতৃত্ব নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। অনেকের কাছে বিষয়টি কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু আমার বিবেচনায় সেটাই হবে সহজতর। বরং হাসিনাকে নিয়ে অগ্রসর হতে চাইলেই বরং বিষয়টা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। শেখ হাসিনা এখন আওয়ামী লীগের জন্য অনেকটা সেই হাতল ভাঙা স্যুটকেসের মতো, বয়েও নেয়া যায় না, ফেলেও রেখে যাওয়া যায় না!