হ ত ভা গা র চি ঠি ১৫

আপাগো কয়টা দিন চুপ থাকা যায় না?

শামীমুল হক | মতামত
ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৫
আপাগো কয়টা দিন চুপ থাকা যায় না?

সুপ্রিয় হাসু আপা, এ ক’দিনে আপনার বক্তব্য দেয়া নিয়ে দেশে কী হয়েছে সবই জেনেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বর বাড়ি। এ বাড়ির উপর এমনভাবে বুলডোজার চালানো হবে- এটা ছিল অবিশ্বাস্য। কিন্তু এ অবিশ্বাস্য কাজই বিশ্বাস্য করে তোলা হলো। জীবনে আপনি কি ভেবেছিলেন আপনার জীবন্ত অবস্থায় এমন চিত্র দেখতে হবে? নিশ্চয় না। তাহলে কেন দেখতে হলো? অনেকেই বলছেন এর জন্য আপনি নিজেই দায়ী। কেননা, আপনার বক্তব্য দেয়াকে কেন্দ্র করেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আচ্ছা আপা, ষোল বছর দেশ চালিয়েছেন জবরদখল করে। গুম, খুন, রাহাজানি, অত্যাচার, হিংসা, প্রতিহিংসা, রাগ, অনুরাগ সবই মিটিয়েছেন বাঙালির ওপর। এসবের প্রতিবাদ করারও সাহস ছিল না কারও। যদিও কেউ আড়ালে আবডালে প্রতিবাদ করতে চেয়েছে তাকেই আপনার রোষানলে পড়তে হয়েছে। আপনার সম্পর্কে আপনার দলেরই শীর্ষ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রকাশ্যে বলে গেছেন- ‘শেখ হাসিনা যারে ধরে তারে ছাড়ে না, এটা বঙ্গবন্ধুর মাইয়া, বাঘে ধরলে ছাড়ে কিন্তু তিনি ধরলে আর ছাড়েন না।’ সুরঞ্জিতের কথার শতভাগ প্রমাণ আপনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। আপনার লোভ আপনাকে আজ এখানে নামিয়ে এনেছে। বিশেষ করে ক্ষমতার লোভ। কি সুন্দর করে তিনটি নির্বাচন করেছেন দেশের মানুষকে ধোঁকা দিয়ে। এমন শাসক পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি হয়নি। নির্বাচনের পর আবার নির্লজ্জের মতো জোর গলায় বলেছেন, জনগণ আমাদের ভোট দিয়েছে বলেই আবার ক্ষমতায় এসেছি। প্রতিটি জনসভায়, আলোচনায় বলতেন- বিএনপি-জামায়াত যেন এ দেশের ক্ষমতায় আর না আসতে পারে। আপনি ক্ষমতায় থাকলে এরা আজীবনও ক্ষমতায় আসতে পারতো না- এটি নিশ্চিত করে বলতে পারি। কারণ বিনাভোটে আপনিই ক্ষমতা ধরে রাখতেন। হয়তো বা আগের রাতেই নির্বাচন শেষ করে ফেলতেন। অথবা আমি আর ডামি নির্বাচন করতেন। কিন্তু এভাবে তিনবার ক্ষমতায় গিয়ে আপনার কী লাভ হয়েছে? আপনি হয়েছেন স্বৈরাচার। নিষ্ঠুরতম স্বৈরাচার। ডিক্টেটর। হায়েনা। অর্থ পাচারকারীদের আশ্রয়দাতা। প্রশ্রয়দাতা। তাই তো আপনি দেশ ছেড়ে পালালে দেশের মানুষ উল্লাসের নৃত্য করেছে। মিষ্টি বিতরণ করেছে। আপনার দলের লোকজনও আপনার সুকর্মের কারণে আপনার পালানোর খবর পেয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। এখনো তারা আত্মগোপনে। সেখান থেকে কেউ কেউ মাঝে মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসে আবারো উস্কানি দেয়। এতে আরও ক্ষিপ্ত হয় এ দেশের আমজনতা। আপনি তো আরও একধাপ এগিয়ে। 

 

ষোল বছর ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেও তৃপ্তি মেটেনি। আরও থাকতে চান। তাই তো পালিয়ে গিয়ে আপনার দলের লোকজনকে হরতাল ডাকার নির্দেশ দেন। প্রতিপক্ষের বাড়িঘর ভাঙার নির্দেশ দেন। ক্ষমতায় থাকতে যেমন দিতেন এখনো তেমনই দিচ্ছেন। আরে আপা, এখন তো আপনাকে বুঝতে হবে আপনি ক্ষমতায় নেই। এখন আপনি দন্তহীন বাঘ। অন্যের দয়ায় বেঁচে আছেন। তাই বলছি ষোলটি মাসও আপনি অপেক্ষা করতে পারলেন না। ষোল বছরের ক্ষমতার কথা ভেবেও তো ষোল মাস অপেক্ষা করতে পারতেন। না! আপনাকে এখনই ক্ষমতায় যেতে হবে। রাজ সিংহাসনে আবার বসতে হবে। এ লোভ ছাড়েন এখন। দলকে বাঁচাতে হলে ধীরে স্থিরে এগোন। দেশের মানুষ আপনার অনুকূলে নাই- এটা আপনাকে মেনে নিতে হবে। এমনকি আওয়ামী লীগের বহু সমর্থকও আপনাকে ঘৃণা করে। আপনি বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের আপা আপা ডাকে মনে করছেন আপনার আগের অবস্থান রয়ে গেছে। ওরা যে ভিন দেশ থেকে কথা বলে। আপনাকে কথা দেয় এই করবো, সেই করবো। এটা বিশ্বাস করেন কীভাবে? ওরাই তো দেশে আসছে না। কারণ ভয়। আওয়ামী লীগের সিল যাদের গায়ে লেগে গেছে তারা এখন খুব বিপদে আছে। আপনার দলের এক নেতা সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী তো বলেই দিয়েছেন আওয়ামী লীগ আর দাঁড়াতে পারবে না। মুসলিম লীগের চেয়েও খারাপ অবস্থা হবে আওয়ামী লীগের। কই আপা আওয়ামী লীগের জন্য এই লতিফ সিদ্দিকীর পরিবারের অবদান আপনার চেয়ে অন্য কেউ বেশি জানে না। এখনো সময় আছে জিহ্বাকে সামলান। দেখবেন একদিন লাইনে উঠতে পারবেন হয়তো। ড. আহমেদ শরীফ স্যার ঠিকই বলতেন- হাসিনা জানে না যে, সে মূর্খ; তাই বেশি কথা বলে। বেশি কথা বলার অভ্যাসটা এখন কমান। এখন আপনার হাতে প্রচুর সময়। বিএনপি-জামায়াতকে ঠেঙ্গানোর পরিকল্পনাও করতে হচ্ছে না। কাকে গুম করতে হবে এ নির্দেশও দিতে হচ্ছে না। তবে দলীয় নেতাকর্মীদের যে নির্দেশনা দিচ্ছেন তা বুমেরাং হয়ে আপনার দিকেই ফিরে যাচ্ছে। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি এখন এক মৃতপুরী। আপনি এজন্য দায়ী। এর দায়ভার অবশ্যই আপনাকে নিতে হবে। বত্রিশ নম্বরে একেকটা ইটের উপর যখন আঘাত করা হয়, তখন সেই আঘাত যেন কলিজায় গিয়ে লাগে। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। সারা দেশের মানুষ টিভির পর্দা আর ফেসবুকে লাইভ দেখেছে। দুয়েকজন সেখানে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে গণধোলাইয়ের মুখে পড়েছে। এরমধ্যে এক নারীও ছিল। যিনি বলছিলেন আর মাইরেন না ভাই। আর মাইরেন না ভাই। কে শুনে কার কথা। 


আপা, আপাগো, কয়টা দিন চুপ থাকা যায় না। দেশে থাকতে তো বক্তব্য দিয়ে মানুষের কান ঝালাপালা করে ফেলেছিলেন। বিএনপি-জামায়াত দেশকে অস্থির করছে। এক বক্তব্যে তো নির্দেশই দিয়েছিলেন খুঁজে খুঁজে বিএনপি ধরে তাদের পিটিয়ে পুলিশে দিতে। আর যে হাত দিয়ে আগুন সন্ত্রাস করছে সেই হাত পুড়িয়ে দিতে। এখনো তো আপনার মুখে একই ভাষা শুনতে পাই। তাহলে কি আপনি সরকার আর বিরোধী দল কি সেটাও বুঝেন না। আর না বুঝেই দেশ চালিয়েছেন। শুধু বুঝতেন কীভাবে ক্ষমতা ধরে রাখা যায় সেটা। ক্ষমতায় থাকতে আপনিসহ আপনার দলের শীর্ষ নেতারা বলতেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি মামার বাড়ির আবদার। বিরোধী দলকে সবক দিতেন সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। কারণ এ সংবিধান আপনি নিজ হাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা কেটে বাদ দিয়েছেন। অদ্ভুত আইন করেছেন। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে নির্বাচন হবে। এতে কি দেখা গেল, নির্বাচনের পর ৬০০ এমপি’র সংসদ হতো। আবার সংসদ না ভেঙেই শপথ নিয়ে নতুন এমপিরা বসে যেতেন। যেন সংসদ একটা মামার বাড়ি। আওয়ামী লীগের জন্য যারা জীবন-যৌবন ত্যাগ করেছেন তাদের দূরে ঠেলে দিয়ে যারা আওয়ামী লীগের সর্বনাশ করতে পারবে তাদের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। লুটপাটের ইজারা দিয়েছিলেন। মানুষকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করতেন না। এই মানুষই যে ক্ষমতায় বসায় সেটা ভুলে গিয়েছিলেন। আর দরকারও ছিল না অবশ্য। কারণ আপনার নির্বাচন পদ্ধতিতে মানুষের ভোটের দরকার ছিল না। এখন একা একা নেতাকর্মীদের না উস্কিয়ে বিগত ষোল বছর কী কী ভুল করেছেন, কারা আপনাকে ডুবিয়েছে, কেন আপনাকে দেশ ছাড়তে হলো? এসব নিয়ে একটু ভাবুন। দেখবেন আপনি আপনার উত্তর পেয়ে যাবেন। দলীয় নেতাকর্মীদের বলুন, এখন চুপ থাকতে। অরাজকতা না করে মানুষের মন জয়ের চেষ্টা করতে। মানুষ কিন্তু সবই বুঝে। মানুষ যে সব বুঝে সেটা শুধু আপনি বুঝেন না। এখন বুঝতে শিখুন। সেদিন দেখছিলাম আপনার একটা বক্তব্য তারেক রহমানকে নিয়ে। বিদেশে বসে না থেকে সাহস থাকলে দেশে আয়। আপনার মুখে এমন কথা মানায় না। আপনার দেখাদেখি আপনার অঙ্গসংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সভাপতিকেও দেখলাম তারেক রহমানকে নসিহত করতে। এখন নিজেদের কথার জালে নিজেরাই তো ফেঁসে গেলেন। তাই কথা বলতে ভেবেচিন্তে বলতে হয়। কথায় বলে না- বন্দুকের গুলি আর মুখের কথা একবার বেরিয়ে গেলে কিচ্ছু করার থাকে না। 
আপা, আপাগো একা শুয়ে শুয়ে চিন্তা করুন- ফোকলা করে রেখে যাওয়া দেশটাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে? দেশটাকে ষোল বছরে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তা থেকে কীভাবে বেরুবে। পারলে নৈরাজ্য সৃষ্টি না করে আপনার দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন দেশের জন্য কাজ করতে। আর আপনি আপনার কর্মকাণ্ডের জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চান। মাফ পেলে পেতেও পারেন। তবে সহসাই তা হবে এটা ভেবে বসে থাকবেন না। 

মতামত'র অন্যান্য খবর