প র্যা লো চ না

মা ও কন্যার ক্ষমতা-বাসনা

শহীদুল্লাহ ফরায়জী | মতামত
ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৫
মা ও কন্যার ক্ষমতা-বাসনা

রাষ্ট্রের প্রতি শেখ হাসিনার কোনো রাজনৈতিক আনুগত্য ছিল না। আনুগত্য ছিল কেবল দল ও রক্তের সম্পর্ক এবং সমপ্রসারিত পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে সীমিত। ফলে নিজ কন্যাকেই যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছেন। কানাডার নাগরিকত্ব বাতিল না করেই সায়মা ওয়াজেদকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মনোনয়ন প্রদান করায়, প্রমাণ হয় শেখ হাসিনার মাঝে কোনোক্রমেই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক কোনো আনুগত্য সৃষ্টি হয়নি। পরিবারের স্বার্থ ছিল সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এজেন্ডা। ‘সম্পদ’ ও ‘ক্ষমতা’ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে রাখাই ছিল শেখ হাসিনার অমেরামতযোগ্য বিনাশ।


গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ও পলায়নরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী-স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদ থেকে বহিষ্কারের দাবি তীব্রতর হচ্ছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। প্রথমত প্রশ্নটি হচ্ছে- একটি রাষ্ট্রের সরকার প্রধান অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিজের কন্যার নাম প্রস্তাব এবং অনুমোদন দিতে পারেন কি-না! যদি বাংলাদেশে একজন মানুষও এই পদের জন্য যোগ্য থেকে থাকেন, তাহলে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নাম প্রস্তাবনায় আসার কথা নয়। কারণ, প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত বা পারিবারিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে জড়িত থাকতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার সময় শপথবাক্যে তাকে পাঠ করতে হয়েছে- ‘রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে, সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিবো।’ কিন্তু শেখ হাসিনা তা রক্ষা করেননি বা করতে পারেননি। সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী আচরণ করা শেখ হাসিনার মনস্তত্ত্বে কোনোদিন ছিল বলে প্রকাশ পায়নি। পেলে নিজের পুত্রকে আইটি এক্সপার্ট হিসেবে নিজে নিয়োগ দেয়া, নিজের কন্যাকে আন্তর্জাতিক সংস্থায়  বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য অনুমোদন দিতেন না। 


শেখ হাসিনা নিজের কন্যাকে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে বসানোর কাজটা কী অবলীলায় করলেন- যা ইতিহাসে প্রায় নজিরবিহীন। ঐতিহাসিক নজির খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, আত্মীয়-স্বজন পোষণে শেখ পরিবার বরাবরই অনন্য। এই ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে অনভিজ্ঞ বা যথার্থ-যোগ্য নয়, এমন কাউকে নিয়োগ দেয়া যায়- এই চিন্তা করার ক্ষমতা শেখ হাসিনা ছাড়া বিশ্বের আর কারও নেই। পুত্র-কন্যাকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য ষড়যন্ত্রের ইতিহাস আছে, কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে স্বজনপ্রীতি করে নিয়োগ দেয়ার ইতিহাস নেই। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে শেখ হাসিনা বলেছিলেন- ‘আমার ছেলেমেয়ের জন্য আমি কিছুই করিনি।’ এ কথা শোনার পর নিজের ছেলেমেয়ের কাছেও যে তিনি অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়বেন, সে বিবেচনাটাও তার নেই।


আজকের গণতান্ত্রিক বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল। এসব হচ্ছে রাষ্ট্রকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার দুরভিসন্ধিমূলক পদক্ষেপ।
এই পদে মনোনয়নের জন্য যারা যোগ্য, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা তাদের সকলের প্রতি কি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করেছেন? নিঃসন্দেহে করেননি। কারণ, এই ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ করা ছাড়াই শুধুমাত্র সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে সরকার। যেখানে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদ জড়িত, সেখানে আইন এবং নৈতিকভাবে কোনোক্রমেই পুতুলের মনোনয়ন চূড়ান্ত হতে পারে না। এমনকি প্রস্তাবনায়ও তার নাম আসার কথা নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- প্রধানমন্ত্রী গোপনীয়তার শপথ গ্রহণ করেও তা লালন করেননি।


ওই শপথে বলা হয়েছে- ‘আমি সশ্রদ্ধ চিত্তে শপথ করিতেছি যে, সরকারের প্রধানমন্ত্রী রূপে যে-সকল বিষয়ে আমার বিবেচনার জন্য আনীত হইবে বা যে-সকল বিষয়ে আমি অবগত হইবো, তাহা প্রধানমন্ত্রী রূপে যথাযথভাবে আমার কর্তব্য পালনের প্রয়োজন ব্যতীত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো ব্যক্তিকে জ্ঞাপন করিবো না বা কোনো ব্যক্তির নিকট প্রকাশ করিবো না।’ কিন্তু শেখ হাসিনা সে-শপথও ভঙ্গ করেছেন। কারণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালকের পদ শূন্য হলে এই পদে বাংলাদেশ থেকে কে অংশগ্রহণ করবে, সে-সিদ্ধান্ত কোনোক্রমেই সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে বলার কথা নয়। এটা রাষ্ট্রের গোপনীয় বিষয়। এই পদে প্রার্থিতা দেয়া এবং কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়ার বিষয়টি কেবলমাত্র সরকার জানবে। অথচ রাষ্ট্রীয় সমস্ত শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে শেখ হাসিনা বহুবছর আগে থেকেই পুতুলকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বা সংস্থার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য প্রটোকলের বাইরে পুতুলকে রাষ্ট্রীয় সফরে অন্তর্ভুক্ত করে, রাষ্ট্রের আর্থিক অপচয়ও করেছেন।


এখন যোগ্যতার বাইরেও তাকে নিয়ে আরও গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে যে- তিনি নাকি কানাডার নাগরিক! অন্য দেশের পাসপোর্টধারী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে কি-না! এ ছাড়াও পুতুলের নামে প্লট বরাদ্দসহ বিভিন্ন অনিয়মে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত, অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পদপ্রাপ্ত সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের মায়ের মতো ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা খুব ঘনীভূত হচ্ছে।
সংস্থাটিতে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের মনোনয়ন শুধুমাত্র রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ন করেনি বরং এই জাতির জালিয়াতির বৈশিষ্ট্য- বিশ্ব দরবারে প্রকাশিত হয়েছে। এর দায় নিরূপণ করতে হবে। কানাডার নাগরিকত্ব রেখে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা একেবারেই অনৈতিক।


মা এবং কন্যা ব্যক্তিগত স্বার্থে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন। সুতরাং এই মুহূর্তে সরকারের করণীয় হচ্ছে:
এক.
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক  পদে সায়মা ওয়াজেদকে  নিয়োগ প্রদানে শেখ হাসিনা সরকার কী কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে, তা দ্রুত তদন্ত করা এবং জনসম্মুখে প্রকাশ করা।
দুই.
সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের কানাডার নাগরিকত্ব বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করা।
তিন.
দুর্নীতিতে অভিযুক্ত থাকায় সায়মা ওয়াজেদের পাসপোর্ট বাতিল করা।
চার.
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে পুতুল কোন্‌ কোন্‌ দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে কী পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় করেছেন, তা নিরূপণের জন্য অনুসন্ধান করা।
পাঁচ.
পুতুলের দুর্নীতির মামলার তথ্য ডব্লিউএইচওকে পাঠানো। 
মা হয়ে কন্যার জন্য ছল-চাতুরীর পথ বেছে নিয়েছেন এবং কন্যাও মায়ের মতো একই পথ অনুসরণ করেছেন। মা ও কন্যা- উভয়ের ক্ষমতা-বাসনা (Will to power) ব্যাপক ও সর্বব্যাপী। ক্ষমতার বিষয়ে সত্য উচ্চারণ (speak truth to power) করার নৈতিকশক্তি মা ও মেয়ের বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মা ও কন্যা ক্ষমতাকে নিজস্ব সম্পত্তি বানানোর ক্ষেত্রে নজিরবিহীন অপদৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।


লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com

মতামত'র অন্যান্য খবর