মানুষ মাত্রই কোনো না কোনো জাতি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। কোনো জাতি একদিনে গড়ে ওঠে না; তার থাকে শত শত বছরের ইতিহাস। পৃথিবীতে জাতিসমূহের ইতিহাস প্রায় কয়েক হাজার বছরের। জাতির উত্থান এবং পতনের ইতিহাসও প্রায় তেমনি। ধীরে ধীরে একটা জাতি বিকশিত হয়ে পরিণতি লাভ করে আবার প্রতিকূল পরিবেশে বিলুপ্ত হয়ে যায়। যেমন সঠিক যত্নের মাধ্যমে একটি বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গমের মাধ্যমে একটা চারা গাছ মাথা উঁচু করে ধীরে ধীরে বিকশিত হয় এবং পূর্ণতা পায়। জাতির ইতিহাসও তেমনি। বাঙালি এমন একটি বিকশিত জাতিসত্তা যার রয়েছে সহস্র বছরেরও অধিক সময়ের ইতিহাস, যেমন- প্রাচীনকাল, মধ্যযুগ, গৌরবান্বিত আধুনিক সময় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবদান রাখার মতো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। ঘোষণা দিয়ে যেমন একটা জাতির জন্ম হয় না, কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না আবার তেমনি কলমের খোঁচায় কোনো জাতির অস্তিত্বকে অস্বীকার বা বিলীনও করে দেয়া যায় না। নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য জাতি হিসেবে আমাদের ঠিকানা বলে দেয়। নাগরিকত্ব এবং জাতিসত্তা: সব মিলিয়ে মোট পাঁচবার বাংলার ভৌগোলিক সীমারেখার পরিবর্তন ঘটেছে। তদুপরি বাঙালি জাতির জাতিসত্তা বদলায়নি। একটি জনপদ বা অঞ্চলের বসবাস করা জনগোষ্ঠীর ভৌগোলিক সীমারেখা রাজনৈতিক কারণে বারবার পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্রীয় নাগরিকত্বের পরিবর্তন হলেও তার জাতিগত বৈশিষ্ট্য বদলায় না। জাতি হিসেবে টিকে থাকা এবং বিশ্বের অন্যান্য উন্নত জাতির সমপর্যায়ে বিকশিত হওয়া অনেক চ্যালেঞ্জিং। এই চ্যালেঞ্জটা যেমন আসতে পারে ভেতর থেকে তেমনি আসে বাইরে থেকেও। ভেতরের চ্যালেঞ্জটা আত্মঘাতী এবং বাইরের চ্যালেঞ্জটা প্রতিযোগিতামূলক। দক্ষিণ এশিয়ায় বহু সমৃদ্ধ জাতি গোষ্ঠীর অবস্থান থাকলেও বাঙালি একমাত্র জাতিসত্তা যারা ১৯৭১ সালে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে।
বাঙালির স্বাধীনতার জন্য শত শত বছরের যে লড়াই এবং সংগ্রাম তারই ফলশ্রুতি ১৯৭১ এর বাংলাদেশ। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম দৃষ্টান্ত বিরল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। বাঙালি জাতির মধ্যেই আমার এবং আমাদের পূর্বপুরুষের ঠিকানা। তুড়ি বাজিয়ে একে উড়িয়ে দেয়া যায় না। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ-১৯৭২ সাল: ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্যকে ধরে রাখতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধকে নেতৃত্বদানকারী প্রবাসী সরকারকে পরের দিন সমাহিত করে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন করেন। যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে পুনর্গঠনের জন্য বিপ্লবী সরকার গঠনের প্রস্তাবও নাকোচ করে দেন। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য দলের দেশ পুনর্গঠনের অংশীদারিত্বকে অস্বীকার করা হয়। শুরু হয় দলীয় স্বৈরাচারী শাসন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলেও দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতি গোষ্ঠীর অবস্থানকে অস্বীকার করা হয়। সংবিধানে উল্লেখ করা হয় ‘বাংলাদেশের জনগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করে। তার ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিবুর রহমান বাস্তবতাকে অস্বীকার করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠী যারা বাঙালি নন তাদেরকে বাঙালি হয়ে যেতে বলেন। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেননি যে, ফরমান দিয়ে কাউকে বাঙালি বানানো যায় না। সেটা ছিল মারাত্মক রাজনৈতিক ভুল।
ষাটের দশকের ছাত্র যুব আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্ব যারা ১৯৬২ সালে গোপন সংগঠন স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গঠন করে ’৫২র ভাষা আন্দোলন, ’৫৪র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধিকারের আন্দোলনকে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছিলেন; সেই নেতৃত্ব শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক ভাবে চ্যালেঞ্জ করে নতুন রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দেন। দিল্লিমুক্ত মধ্যযুগ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকশিত রূপ: বাঙালি জাতির বিকাশের ইতিহাস হাজার বছরের উপরে হলেও বাঙালির জাগরণের ঘটনা ঘটেছে বেশ পরে। দিল্লির কর্তৃত্ব, দখলদারিত্ব এবং আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাংলার যুদ্ধ অনেক পুরনো, তা দিল্লিতে যে শাসকই থাকুক না কেন। বাংলা সবসময় স্বাধীন থাকতে চেয়েছে, তা যেমন মধ্যযুগে তেমনি বর্তমানেও। দিল্লির কর্তৃত্ব থেকে বাংলা স্বাধীন ছিল সুলতানি আমলে (১৩৩৮-১৫৩৮)। প্রাকৃতিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে (হধঃঁৎধষরুধঃরড়হ) সুলতানগণের বাঙালি সমাজ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের আত্তীকরণ ঘটে। তারা মিশে যান বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির মাঝে। ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁয়ে স্বাধীন সুলতানি যুগের সূচনা করেন। তখন থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর ধরে বাংলাদেশ অবিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীনতা ভোগ করে। এ সময় বাংলার সুলতানগণ নিজেদের যোগ্যতা, শক্তি ও ঐশ্বর্য দিয়ে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠদের পাশে নিজেদের স্থান করে নিয়েছিলেন। তারা বাংলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন এবং জনকল্যাণধর্মী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। তাই দু’শ বছরের এই স্বাধীন যুগটিকে বাংলার গৌরবময় যুগও বলা হয়। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্মেষ/বিকাশ ঘটে এই সুলতানি আমলে। এই সুলতানি আমলেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের অঙ্কুর প্রোথিত হয়। এই সময়েই বাংলা রাজকীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৫-১৬ শতকে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৪-১৫১৯) এবং শ্রী চৈতন্য দেবের (১৪৬৮-১৫৩৪) সময়কালে ইসলামী সংস্কৃতি এবং বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে বাঙালির জীবনধারায় ‘প্রথম জাগরণ’ সূচিত হয়। তারও তিন শতাধিক বছর পর উনিশ শতকে পাশ্চাত্য প্রভাবে ঘটে ‘দ্বিতীয় জাগরণ’ যার নাম ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’। এই দুই জাগরণের ভিত্তি ছিল সমাজের অভিজাত শ্রেণির মধ্যে।
সমাজের ভিত্তিমূলে উৎপাদন ব্যবস্থায় যেহেতু কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি তাই এই জাগরণ ছিল স্বাভাবিকভাবেই ক্ষণস্থায়ী। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পৃথিবীর মানচিত্রে বাঙালি নিজস্ব পরিচয়ে নিজস্ব রাষ্ট্র কাঠামো স্থান করে নেবে- এটা প্রায় অনেকের কাছে অকল্পনীয় ছিল। বাঙালির মনস্তাত্ত্বিক/মনস্তত্ত্বে চেতনা বোধ থাকার পরও, ১৯৭১ সালে বাঙালির জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টির মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে বাঙালি তৃতীয় জাগরণের পর্যায় অতিক্রম করছে। পেশাদারিত্বের দিক থেকেও এটা প্রমাণিত যে, বাঙালি পেশাজীবীরাও অন্যান্য উন্নত জাতির পেশাজীবীদের পেশাদারিত্বের সমকক্ষ। অর্থাৎ মাছে ভাতের কৃষিজীবী বাঙালি আর সেই আগের অবস্থানে নেই। উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নতুন নতুন উন্নত পেশাগত অবস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। বাঙালির তৃতীয় জাগরণের এই প্রক্রিয়া আজও চলমান। বাঙালির এই জাগরণের ভিত্তি হচ্ছে সমাজের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা নতুন নতুন সামাজিক শক্তিসমূহের উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদের বিশ্বমানের পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আমাদের অতীতের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে তাকালেও এই উন্নত পরিবর্তনের ধারাটি সহজেই অনুমেয়। ১৯৭১ সালে বাঙালির রাষ্ট্র ব্যবস্থা বাঙালি জীবনে তৃতীয় জাগরণের পথকে প্রশস্ত করে দিয়েছে। তৃতীয় জাগরণের এই পর্যায়কালে বাঙালি জীবন ও সমাজের ভিত্তিমূলে অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন ঘটায় তা সম্ভব হয়েছে। অতীতের কৃষিজীবী বাঙালি বা মৎস্যজীবী বাঙালি আজ পেশাজীবী এবং পৃথিবীর যেকোনো দেশে যেকোনো পেশায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। এই এক নয়া পরিচিতি, যার দ্বারা বাঙালি আজ পৃথিবীর যেকোনো জাতির সমতুল্য। যেকোনো স্বাধীন দেশে জাতীয় চেতনা গড়ে ওঠে এবং এর বিকাশের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সমাজের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা শক্তিসমূহের দ্বান্দ্বিক কার্যক্রম। জাতীয় রাজনীতিতে সামাজিক শক্তিসমূহের ভূমিকার উপর নির্ভর করে সেই জাতির অস্তিত্ব, উন্নতি এবং অগ্রগতি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষেরা এর চালিকাশক্তি। এখন যা আবশ্যক তা হলো প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে যারা সমাজের চালিকা শক্তি তাদেরকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় এবং দেশ পরিচালনায় সুযোগ করে দেয়া। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে প্রয়োজন যুগান্তকারী রাষ্ট্রীয় সংস্কারের মাধ্যমে বৈষম্যমূলক সম্পর্কের অবসান ঘটানো এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
প্রয়োজন এমন এক রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং শাসন ব্যবস্থা যার কল্যাণে দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণ নিরাপদ থাকবে। গণতন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে জনগণের অধিকারের ক্ষমতা। তৃতীয় জাগরণ চলমান; বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যার পথ প্রশস্ত হয়েছে; এর মাধ্যমেই বাঙালি তার উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাবে পৃথিবীর অন্যান্য জাতিসত্তার সঙ্গে একটি সৌন্দর্য ও প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে। উপসংহার: পৃথিবীর বহু দেশে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে একাধিক জাতি গোষ্ঠীর সহ অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। সাংবিধানিকভাবে এইসব জাতি গোষ্ঠীর স্বীকৃতিও আছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই ’৫২র বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ষাটের দশকের ছাত্র যুব আন্দোলন এবং স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়ে বাঙালি জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে বাংলাদেশের জনগণের বৃহত্তম অংশ বাঙালি (প্রায় ৯৯ ভাগ) এবং এর পাশাপাশি ক্ষুদ্র একটি অংশ কমপক্ষে ৫০টি জাতি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বসবাসরত অবাঙালি/ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নাম পাওয়া গেছে ৫০টি। এর বাইরে আরও কিছু জনগোষ্ঠী আছে। কিন্তু তাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। বাংলাদেশে অবাঙালি/ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মোট জনসংখ্যা ১,৬৫০,১৫৯ জন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১%। চট্টগ্রাম বিভাগের মোট জনসংখ্যার ২.৯৯% ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। দেশের ১১.১৯ শতাংশ আয়তনের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করেন মোট জনসংখ্যার ১.১৬ শতাংশ মানুষ। সেহেতু বাংলাদেশের জনগণ হবেন নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি। সংবিধানের মূলনীতিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যেমন উল্লেখ থাকবে তেমনি অন্যান্য অবাঙালি/ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জাতিসত্তার বিকাশের বিষয়টিও উল্লেখ থাকতে হবে। এর মাধ্যমে সকল জাতিসত্তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে। সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত কমিশন তাদের সুপারিশে সংবিধানের মূলনীতি থেকে ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদ মুছে না ফেলে বাঙালি জাতিসত্তার পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাবনাই হতো অতীতের ভুলের সংশোধন এবং যুগোপযোগী পদক্ষেপ।
সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে স্বীকৃতি না দিয়ে মূলনীতি থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুছে দেয়ার অর্থই হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোকে আবারো সংকটে রাখা। এ যেন মাথাব্যথায় মাথা কেটে ফেলার মতো। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্নত বিকশিত রূপ তৃতীয় জাগরণের যে পর্যায় এখন চলছে সেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এতে কোনো সংকটে পড়বে না। উল্লেখ্য, যে তীব্র ছাত্র গণ-আন্দোলনের মুখে ৫ই আগস্ট এক গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন হয় যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রধান প্রধান সমন্বয়কগণ। তারা যেমন জুলাই-আগস্টের প্রোক্লেমেশন যৌক্তিক দাবিদার তেমনি ষাটের দশকের ছাত্র যুব আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্ব যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করে ধীরে ধীরে সে আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত করেছেন সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ যদি সংবিধানের মূলনীতিতে ঘোষিত না থাকে তা হবে আত্মঘাতী। বাঙালি জাতীয়তাবাদই ছিল ষাট দশকের আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল ভিত্তি। আমরা যদি ষাটের দশকের তরুণদের প্রোক্লেমেশন ধারণ করতে না পারি তাহলে আমরা কি করে আশা করবো যে, আগামী প্রজন্ম আজকের তরুণদের প্রোক্লেমেশন ধারণ করবে।
লেখক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক