জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা নিয়ে জটিলতা কাটছে না। একদিকে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের ঘোষণাপত্র নিয়ে অনড় অবস্থান, অন্যদিকে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের আপত্তিতে আটকে আছে ঘোষণাপত্র চূড়ান্তকরণ ও পাঠ। সরকারও বেকায়দায় বিষয়টি নিয়ে। কারণ সবার মধ্যে ঐকমত্য না হলে এ উদ্যোগ ব্যাহত হতে পারে। গত ১৫ই জানুয়ারি এ বিষয়ে সমাধান খোঁজার জন্য সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেই বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র হওয়ার বিষয়ে মতৈক্য তৈরি হলেও কবে নাগাদ এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত হবে তা স্পষ্ট ছিল না। কারণ বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের বিষয়বস্তু নিয়ে ঘোর আপত্তি আছে রাজনৈতিক মহলে। এ ছাড়া ঘোষণাপত্রটি কারা প্রস্তুত করবে সেটা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
বিএনপি প্রশ্ন রেখেছে, সাড়ে পাঁচ মাস পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল কিনা। যদি থেকে থাকে, সেটার রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক এবং আইনি গুরুত্ব কী। এ ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে যাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখার পরামর্শ দিয়েছে দলটি। এ ছাড়াও দলটি ’৭২-এর সংবিধান নিয়ে যে বক্তব্য আছে সেটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াত ঘোষণাপত্রের পক্ষে অবস্থান নিলেও বিগত সরকারের সময়ে ‘অস্বচ্ছ’ বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের নেতাদের ফাঁসি দেয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের ৪ মাসের মাথায় ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা’র বিষয়টি সামনে আনেন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। ২৮শে ডিসেম্বর বিকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে সরব হন তারা। যে প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন ছাত্র আন্দোলন থেকে সরকারে স্থান পাওয়া উপদেষ্টারাও। হ্যাশট্যাগে প্রচার করা হয়, ‘নাও অর নেভার’। ছাত্ররা যখন ৩১শে ডিসেম্বর জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তখন সরকার থেকে বলা হয়, এটিকে যেন বেসরকারি উদ্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সেই সময় ছাত্ররা নিজেদের করা ঘোষণাপত্রের খসড়া পাঠায় রাজনৈতিক দলগুলোকেও। কিন্তু এ খসড়া নিয়ে আপত্তি তৈরি হয় রাজনৈতিক দলের মধ্যে। ছাত্রদের ঘোষণাপত্র নিয়ে দলীয় অবস্থান জানাতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জরুরিভিত্তিতে দেখা করেন সরকারপ্রধান ড. ইউনূসের সঙ্গে। এ সময় তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে বিএনপি’র উদ্বেগের কারণ জানান। বিএনপি নেতারাও বিভিন্ন বক্তব্যে যখন জুলাই বিপ্লবের ঘোষণার উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করছেন তখন ছাত্রদের একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করেন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। আমন্ত্রণ জানানো হয় এ উদ্যোগে যোগ দিতে। কিন্তু সরকারপ্রধান এতে সায় দেননি। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলে এ উদ্যোগ ব্যাহত হবে। সেদিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছাত্রদের ভিন্নমত তৈরি হয়। যে বিষয়ে সর্বদলীয় বৈঠকেও কথা বলেন তিনি। বলেন, আমি বুঝতে চাইলাম কী ঘোষণা দিচ্ছে। শুনে আমি বললাম- এটা হবে না। আমার যাওয়াটাও হবে না, তোমাদের করাও ঠিক হবে না। তোমরা যদি ৫ই আগস্টে ফিরে যেতে চাও সেদিনের পরিপ্রেক্ষিতে যেটা হয়েছিল সেটাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। কাজেই তোমরা করতে চাইলে সবাইকে নিয়ে করতে হবে। এটা পরিষ্কার। এটা না করলে ঠিক হবে না।
শুরু থেকেই সরকার ছাত্রদের উদ্যোগ জানার পর বিষয়টি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে বলে ধারণা করে। যার প্রেক্ষিতে ঐক্যে জোর দেয়া হয়। ছাত্রদেরও সেইভাবে পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও বিষয়টি নিয়ে সবার মত নিতে গেলে জটিলতা বাড়বে বলে মনে করেন। তাই নিজেদের প্রস্তুতকৃত ঘোষণাপত্র পাঠ করতে তৎপর হয়। এরই মধ্যে ৩০শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, ঘোষণাপত্র সরকারই প্রস্তুত করছে। রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে কথা বলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা হবে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ধাক্কা খায় ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। ওইদিন রাতে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন তারা। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের ওইদিনের বৈঠকে নানা মত আসে। বেশির ভাগ নেতা ঘোষণাপত্র পাঠের পক্ষে মত দেন। তাদের যুক্তি ছিল এটি সরকার দিতে গেলে নানা ধরনের চাপ আসবে। ছাত্র আন্দোলন থেকে উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পাওয়া সরকারের এক উপদেষ্টার চাপে সেদিন ঘোষণাপত্র পাঠ থেকে সরে আসেন ছাত্ররা। বিষয়টি নিয়ে বিক্ষুব্ধ হন ছাত্রনেতারা। কিন্তু ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে ঢাকায় আসা নেতাকর্মীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মার্চ ফর ইউনিটি কর্মসূচি পালনে সিদ্ধান্ত হয়। রূপায়ণ টাওয়ারে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তারা জানান, আমরা সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আমরা মনে করি এটি আমাদের প্রাথমিক বিজয়। সরকার আমাদের উদ্যোগের পর ঘোষণাপত্র প্রস্তুতের উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা শহীদ মিনারে মার্চ ফর ইউনিটি কর্মসূচি পালন করবো।
ছাত্রদের ওই কর্মসূচিতে ব্যাপক জমায়েত হয়। সারা দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। যেখান থেকে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা, জুলাই ঘোষণার জন্য সরকারকে ১৫ দিন সময় বেঁধে দেন। কিন্তু ছাত্রদের বেঁধে দেয়া সময়ে বিষয়টি নিয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। শুরুতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলা হলেও তারও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এমনকি ১৫ই জানুয়ারি পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও আগের দিন পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বিষয়টি নিয়ে জটিলতা তৈরি হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ১৪ই জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে হুঁশিয়ারি দেয়। এরপর ১৫ই জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় বৈঠক। যে বৈঠকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রস্তুতের সিদ্ধান্ত হয়। এটিকে নিয়ে যেন কোনো ধরনের ফাটল না ধরে সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়। বৈঠকে ঘোষণাপত্র নিয়ে কালক্ষেপণ আবার তাড়াহুড়ো না করার বিষয়েও কথা হয়। এ ছাড়া কোন কোন বিষয় থাকবে, অংশীজনদের নাম থাকা এবং ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করতে একটি কমিটি গঠনেরও প্রস্তাব করা হয়। যে কমিটিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্রপ্রতিনিধি ও সরকারের লোক থাকতে পারে বলে জানানো হয়। তবে কবে নাগাদ এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত হবে তা স্পষ্ট করা হয়নি। এমনকি খসড়াটি কে করবে- সরকার না শিক্ষার্থীরা, না কি সংবিধান সংস্কার কমিশন তাও স্পষ্ট হয়নি।
এদিকে ছাত্রদের তৈরি করা ঘোষণাপত্রের প্রথম খসড়া ও সর্বদলীয় বৈঠকের আগে রাজনৈতিক দলকে সরকারের একজন উপদেষ্টার পাঠানো দ্বিতীয় খসড়ার মধ্যেও আসে বেশ কিছু পরিবর্তন। দু’টি ঘোষণাপত্রই ৫ই আগস্ট থেকে কার্যকর হবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। ছাত্ররা প্রথম যে খসড়া তৈরি করে সেখানে বলা হয়, এ বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে। আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক করা হবে দেশের রাজনীতিতে। কবর রচনা করা হবে মুজিববাদী ১৯৭২ সালের সংবিধানের। এতে স্থান পায়, ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সংগ্রামী ইতিহাস। এ ছাড়াও ’৭২-এর সংবিধানকে ‘মুজিববাদী সংবিধান’ আখ্যা দিয়ে এর সমালোচনা করা হয়। এতে বলা হয়, দেশের গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ সংবিধানের কারণে ধ্বংস হয়েছে। এ সংবিধানের দোহাই দিয়ে কেড়ে নেয়া হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার। সমালোচনা ছিল ১/১১-এর ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়েও। শেখ হাসিনা ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কীভাবে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছেন তার উল্লেখ করে বলা হয়, এর মাধ্যমে দেশে গুম-খুনের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এমনকি রাষ্ট্রীয় মদতে পিলখানা, শাপলা চত্বরসহ বিভিন্ন হত্যাযজ্ঞের কথা ঘোষণাপত্রে স্থান পায়। এ ছাড়া, ভারতবিরোধী অবস্থানের কারণে কীভাবে দেশে গুম- খুনের রাজনীতি কায়েম করেছে হাসিনা সরকার, তার বর্ণনা ছিল। বলা হয়, কীভাবে বিগত শেখ হাসিনা সরকার সংখ্যালঘু ট্রাম্প কার্ড ব্যবহার করে এ দেশে বিভাজন তৈরিতে কাজ করেছে। ন্যায্য দাবিতে রাজপথে নেমে আসা শ্রমিক হত্যার কথাও রাখা হয়। এ ছাড়াও ঘোষণাপত্রে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করার জন্য ফ্যাসিজম কীভাবে কাজ করেছে তার উল্লেখ ছিল। এ ব্যবস্থার কারণে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তারা আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করেছে। বিগত তিনটি অবৈধ নির্বাচন, বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন, নাগরিক বৈষম্যের কথা রাখা হয়। বিশেষ করে জুলাই-আগস্টের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে ছাত্রদের আন্দোলনে এ দেশের আপামর জনসাধারণের সম্পৃক্ততার কথা বীরত্বের সঙ্গে উল্লেখ ছিল। একইসঙ্গে সেই আন্দোলনে হাসিনার দমন-পীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের কথা স্থান পায়। বলা হয়, এ আন্দোলনের মাধ্যমে এদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি পুনরুদ্ধার করা গেছে। ঘোষণাপত্রে হাসিনার পতনের পর বঙ্গভবনের বৈঠকে প্রেসিডেন্টের কাছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবির বিষয়টিও রাখা হয়। বাতিল চাওয়া হয় ১৯৭২ সালের সংবিধানের। একইসঙ্গে ঘোষণাপত্রে গুম, খুনসহ মানবতাবিরোধী সব কর্মকাণ্ডের বিচার চাওয়া হয়। মূলত শিক্ষার্থীরা বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি রাখা হয় ঘোষণাপত্রে। একইসঙ্গে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকা সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার আহ্বান জানানো হয়।
আর সরকার থেকে পাঠানো খসড়ায় ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়াও জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায় এই ভূখণ্ডের মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুগের পর যুগ সংগ্রামের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন, ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়। এর পরের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে কীভাবে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণ-বিক্ষোভ গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান, সে প্রসঙ্গও রয়েছে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায়। খসড়ায় বলা হয়, আমরা, ছাত্র-জনতা সেই অভিপ্রায়বলে আত্মমর্যাদা, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের যে আদর্শে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য সার্বভৌম জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের সংগঠিত করিলাম। আমরা, প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি এবং ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও অখণ্ডতা রক্ষার্থে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আহ্বান জানালাম। আমরা সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি রোধ নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করবে, এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম। খসড়ায় আরও বলা হয়, ‘আমরা ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে লালন করার দলিল ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন বা প্রয়োজনে বাতিল করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম। আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচার করা হবে, এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম। আমরা এই ঘোষণা প্রদান করলাম যে, ১৯৭২ এবং ১/১১ কালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য আমাদের একটি নতুন জনতন্ত্র (রিপাবলিক) প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রে সকল ধরনের নিপীড়ন, শোষণ ও বৈষম্যের অবসান ঘটাবে এবং এ দেশের তরুণ সমাজের প্রত্যাশাকে ধারণ করতে পারবে। আমরা এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম যে, এই ঘোষণাপত্রকে উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।’
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলো ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিলুপ্তি ও বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ইসলামী দলগুলোর ভূমিকার বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য চায়। ১৫ই জানুয়ারির বৈঠকেও এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে সে সময় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই বিষয়টি নিয়ে জটিলতা কাটছে না। এদিকে সরকারের একজন উপদেষ্টা ১৩ই জানুয়ারি বলেছেন, ঘোষণাপত্রে সরকার কেবল ফ্যাসিলিয়েট করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার আসলে কী চাইছে। কারণ তারা শুরুতে এটিকে প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ বললেও মাঝে সরকার থেকে প্রস্তুতের কথা জানায়। এরপর নতুন করে বলা হচ্ছে তারা কেবল ফ্যাসিলিয়েট করবে। ১৫ই জানুয়ারির সর্বদলীয় বৈঠকেও ঠিক হয়নি কে এটি করবে। সেদিনের পরামর্শ ছিল এই বিষয়ে একটি কমিটি গঠনের। এ ছাড়াও সংবিধান সংস্কার কমিশনকে এই দায়িত্ব দেয়ার বিষয়টিও আলোচনা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এদিকে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়েছে। তারা এর জন্য সরকারে থাকা তাদের প্রতিনিধিদের দায়ী করেছেন। ছাত্ররা মনে করেন, এটি যদি না দেয়া যায় তাহলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরা যাবে না। দেশে ফ্যাসিবাদী কাঠামো আবার শক্ত ভিত গড়বে। এ ছাড়া ভবিষ্যৎে ’৭২-এর সংবিধানকে সামনে রেখে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা কোনো দল তাদেরকে জুলাই-আগস্টের কর্মকাণ্ডের জন্য বিচারের মুখোমুখি করতে পারে। তাই এমন একটি ঘোষণা জরুরি। যেটি পরবর্তীতে সংবিধানে যুক্ত থাকবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এ ঘোষণাপত্র কে দেবে। সরকার না ছাত্ররা। না কি এ ইস্যুতেও প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ ইস্যুর মতো পিছু হটবেন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা- সেটিই এখন দেখার বিষয়।